মাতাল পদ্মার খপ্পরে আবার

‘পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা’ গানটা শুনে দয়া করে পদ্মাকে ভুল বুঝবেন না। বর্ষায় এ নদীর গায়ে রোমান্টিকতার র-ও থাকে না। এ নদী তখন পাগলিনী-ডাকিনী-সর্বনাশী। কাজী নজরুলের লেখায় ও সুরে গানটা শুনে মন বিরহে কাতর হয়। কিন্তু সেটা শুনে পদ্মায় নামলে ভুল করবেন। বিশেষত এই বর্ষায়। এই পদ্মার ঠেকা পড়েনি কোনো বিরহীর শূন্য হৃদয় বয়ে নিতে। এই পদ্মা হৃদয় শূন্য করে দেবে আতঙ্কে। অধমের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনো একটা হয়েছিল, তাই নদীর মন না জেনে সেই রোমাঞ্চকর জলজ নাগরদোলায় চড়েছিলাম। একবার নয়, দুইবার। প্রথমবার এই মাওয়াতেই। দ্বিতীয়বার ফরিদপুরের পদ্মায় আর এবার আবার মাওয়া ঘাটের কাছেই।

শেষবারের কথাটাই আগে বলি।

খুলনা থেকে ১৫ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার বাসে ঢাকা আসব। কথা ছিল সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা লাগবে পদ্মার ওপারে, এরপর দেড় ঘণ্টা রাতের ফেরিতে। আর মাওয়া ঘাটের এপারে দেড় ঘণ্টা। ব্যস। কিন্তু কিসের কী। সারা রাত শরীয়তপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে বাস আটকে রইল। আষাঢ়ের পয়লা দিবস। রাতভর বৃষ্টি, সকালেও থেমে থেমে তারই রেশ।

ফেরি ছাড়ল সাড়ে নয়টার পর। কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে মাওয়ার দিকে আসতে যে নদী পড়বে, লোকে তাকে বলে পদ্মা নদী। আসলে সেটা একটা খাল। ফারাক্কা বাঁধের মহান অবদান, পদ্মা হলো খালের সমান। সেটা দিয়েই সাবধানে ফেরি-লঞ্চ-স্পিডবোট সব চলে। মোটামুটি এক ঘণ্টা পেরোলে তবে মূল পদ্মার দেখা মেলে।

সেটা তো মিলল, তার মানে আর সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা লাগবে ঘাটে পৌঁছাতে। এতক্ষণ ফেরির আগে-পরে ছোট ছোট লঞ্চ দিব্যি চলছিল। ফেরির পেছনের দিকের নদীতে তাকিয়ে চরের ঘরবাড়ি দেখছি। হঠাৎ একটা লঞ্চ নাক ঘুরিয়ে পাশের চরের দিকে ছুটতে শুরু করল। তার দেখাদেখি আরেকটা। তার দেখাদেখি আরেকটা। কী ব্যাপার!

একটা লঞ্চ ছিল সামনে। তার আর ফিরে আসা কঠিন। সেটা সোজা না গিয়ে বাঁ দিকে কোন নিরুদ্দেশের দিকে যে ছুটল!

ঝড়বাদল নেই। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। এমন রোদ–ঝকঝকে আকাশ যেন মনে হয়, আকাশ থেকে নীল আর মেঘ থেকে সাদা নিয়ে সুন্দর আর্জেন্টিনার পতাকা বানানো যাবে। এর মধ্যে কেন ভয় পেল লঞ্চগুলো? ফেরির ছাদের যাত্রীদের একজন বললেন, ‘নদীতে দেখসেন কেমন ঢেউ?।’ খাল পেরিয়ে যেখানে নদীর শুরু, সেই নদীর মাঝ বরাবর বড় এলাকাজুড়ে আধা মাইল দূর থেকেও সাদা সাদা ঢেউয়ের ফেনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ আর এমন কী?

কী, সেটা বুঝলাম কাছে গিয়ে। বাংলাদেশের বিরাট অঞ্চলের ওপর দিয়ে তখন হু হু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বাতাস আর পদ্মা হলো সোনায় সোহাগা। বাতাসের নেশায় পদ্মা তখন মাতাল। তাড়াতাড়ি তিনতলা ফেরির ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম। নদী যেন আগ্নেয়গিরির মতো উথলাচ্ছে। বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ছে ফেরির গায়ে, আর ফেরিটা ডানে-বাঁয়ে হেলছে। ঢেউয়ের ধাক্কা আর বাসের গায়ে আরেকটা বাসের মাঝারি মাত্রার ধাক্কার মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। বড় বড় ঢেউ ফেরির ডেকের লোহার দেয়ালের তলা দিয়ে ঢুকে পড়ছে মাঝেমধ্যে। নিচতলায় যারা সেদ্ধ ডিম, ছোলা, চানাচুর বিক্রির জন্য বসেছিল, মালামাল ভেজা থেকে বাঁচতে তারা দোতলায় চলে গেল। রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ মানুষ চিৎকার করে দোয়া পড়ছেন আর আল্লাহকে ডাকছেন।

ফেরি সাধারণত ডোবে না, বড়জোর ঢেউয়ের টানে আরেক দিকে চলে যায়। কিন্তু শাহ মখদুম নামের বিশাল ফেরিটা ডানে-বাঁয়ে প্রায় ৩০ ডিগ্রি দুলতে থাকায় ইয়া নফসি ইয়া নফসি রব উঠল যাত্রীদের মধ্যে। আমি তো একদম নিচের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মোবাইলে ভিডিও করছি। আমার পেছনে প্রায় ২০ ফুট দূরে বৃদ্ধ মানুষটি চিৎকার করে মাফি চাইছেন আল্লাহর কাছে। এমন সময় ফেরির লাউড স্পিকারে ভেসে এল চিৎকার। ‘এই, আপনারা সরে আসেন, এখনই সরে আসেন।’ প্রথম বাণীটা আমাদের দুজনের উদ্দেশে। এরপর ডাক এল, ‘যাত্রীরা কেউ নিচে থাকবেন না, দুই গাড়ির মাঝখানে থাকবেন না।’

প্রচণ্ড বাতাসে টাঙানো শামিয়ানা যেভাবে একবার ফুলে ওঠে আরেকবার চুপসে যায়, পদ্মার বুক সেভাবে ফুলছে, ফাঁপছে, তারপর ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে। অথচ আকাশ কী ঝকঝকে পরিষ্কার। দেখে বোঝার উপায় নেই, নদী কতটা মাতাল।

ঢেউয়ের ধাক্কা বেড়েছে। গাড়িগুলো দুলছে। কোনো কারণে ফেরি আরও কাত হলে পাশাপাশি দাঁড়ানো গাড়িগুলো গায়ে গায়ে ধাক্কা খেতে পারে। সে সময় দুই গাড়ির মাঝখানে কেউ থাকা মানে সর্বনাশ। একদম থেঁতলা হয়ে যাবে। ভিডিওর লোভ ছাড়তে নারি, আবার নিরাপদও থাকা দরকার। নিরাপদ জায়গা বেছে নিলাম।

এভাবে চলল প্রায় ২০ মিনিটি। একসময় ঘাটে ভিড়ল ফেরি। জানলাম লঞ্চ-স্পিডবোট চলাচল একদম বন্ধ। ফেরি চলাচলও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। মনে পড়ল বাঁ দিকে চলে যাওয়া লঞ্চটির কথা, যেটা চরে ভিড়তে পারেনি। নদীর মধ্যে সেটাকে খুঁজলাম। একসময় পেলাম। বেশ কয়েক মাইল ঘুরে পাড় ঘেঁষে সেটা আসছে। যাক কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

এবারে ভয়ের চেয়ে রোমাঞ্চ ছিল বেশি, কিন্তু বছর দুই আগে, এমন ঢেউয়ের মধ্যে স্পিডবোটে সত্যিই মৃত্যুভয় পেয়েছিলাম। এখানে প্রায়ই নৌডুবিতে মানুষ মারা যায়। চাঁদপুরের কাছে যেমন নদীর পাক, মাওয়া ঘাটের কাছে তেমন আছে সর্বনাশা ঢেউ। গত বছরের বন্যার সময় ফরিদপুরের ইঞ্জিন নৌকায় করে পদ্মা পেরিয়ে এক চরে যাওয়ার সময়ও ভয় কম লাগেনি।

ফারাক্কার পানি সারা বছর না ছাড়লেও ভারত বর্ষায় বাঁধ খুলে দেয়। তাতে উত্তরবঙ্গে যে বন্যা হয়, সেই পানি মাওয়া দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে তুমুল বেগে ছুটে চলে। তারই ধাক্কা খেয়ে বুঝলাম, সারা বছর পদ্মা শুকিয়ে আসা সাবেক পালোয়ানের মতো করুণ দেখালেও এ সময়টাতেই নদীটা হারানো যৌবন ফিরে পায়। হয়তো জানান দেয়, তোমরা যতই আমাকে বন্দী করো বাঁধ দিয়ে, আমার বুকে সেতু বসিয়ে, অজস্র চরের টিউমারে আমাকে ভরিয়ে দিয়ে—আমি অহনতরি মরি নাই!

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]