হামাগুড়ি দিয়ে পথচলা

জন্মের পর থেকেই অমৃত বালার পিছু ছাড়েনি যে তার নাম ‘নেই’। জন্মের সময় থেকেই হাঁটুর নিচের অংশ নেই। আগে একটা হুইলচেয়ার ছিল, এখন তা–ও নেই। বাবা থেকেও নেই। তাঁর জন্মের পর বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। বড় ভাই শঙ্কর কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। সংসারে নুন আছে তো পান্তা নেই। এই ‘নেই রাজ্যের বাসিন্দা’ অমৃত বালার আছে এক মোক্ষম অস্ত্র। সেটি হলো মনোবল। তীব্র দারিদ্র্যক্লিষ্ট হয়েও তিনি ভেঙে পড়েননি। প্রতিবন্ধিতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি বরগুনা সরকারি কলেজে স্নাতক (পাস) শ্রেণিতে পড়ছেন। প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে বাস, ইজিবাইক বা পিকআপে করে পুরাকাটা গ্রাম থেকে উপজেলা সদরে যান। সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কলেজে যান।
অদম্য অমৃত বালার মনোবল ও স্পৃহা তারুণ্যের জন্য এক অনন্য প্রেরণা। শারীরিক, আর্থিক, সামাজিক—সব ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তিনি যখন তাঁর লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন একটি বিষয় সবার সামনে এসে দাঁড়ায়—সমাজের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের বিদ্যমান সহায়তামূলক কার্যক্রম কতটা ভূমিকা রাখতে পারছে, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে ধরা দেয়।
সরকারি নীতিতে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অনেক কিছু ঘোষিত হলেও উপকৃত প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। সে কারণে হতভাগ্যদের দিনের পর দিন অসহনীয়, দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। সরকার প্রতিবন্ধী স্বনির্ভরতার কথা বারবার বললেও তাঁদের আসল অবস্থা করুণ।
অমৃত বালা যে জেলার বাসিন্দা, সেই বরগুনার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ২০১৩ সালে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সরকারি হিসাবে কেবল বরগুনাতেই প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ১১ হাজার। বেসরকারি পরিসংখ্যান এর দ্বিগুণের মতো। এঁদের মধ্যে সনদ রয়েছে মাত্র ৭০৩ জনের! সরকারি সংস্থার চোখে অন্যরা যেন থেকেও নেই। বর্তমানে সেই অবস্থার দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।
একজন প্রতিবন্ধীকে শিক্ষার আলো পেতে গেলে আজও নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সরকার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের যে ভাতা দিয়ে থাকে, যথাযথ সময়ে প্রচারের অভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে তা খুবই কম পৌঁছায়। অর্থের অভাবে মাঝপথে অনেককে পড়াশোনা বন্ধ করে বিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয়। অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর পরিবার জানেও না এই ধরনের শিক্ষাবৃত্তি সরকার আদৌ
দেয় কি না।
অমৃত বালার মতো মনোবল অধিকাংশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরই নেই। তাঁদের বেশির ভাগের জীবন কাটে হতাশায়। কিন্তু তাঁরাও যে জনসম্পদ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেন, সেটি ভুলে গেলে চলবে না। প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে দেশ ও সমাজের জন্য তাঁরা সম্পদে পরিণত হবেন। সে জন্য কর্মপরিবেশ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাঁদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন যথাযথভাবে করতে হবে।