রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট

যেখানে বাংলাদেশের বহু নাগরিককেই পাসপোর্ট তৈরি করতে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়, সেখানে বাংলাদেশের নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিদের অনায়াসে পাসপোর্ট পেয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক বটে। কিন্তু বাংলাদেশে অস্বাভাবিক ঘটনার অভাব নেই।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দিতে একটি চক্র গড়ে উঠেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী, পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা এবং দালালদের নিয়েই চক্রটি গড়ে উঠেছে। দেশের একজন প্রকৃত নাগরিকও চাইলেই পাসপোর্ট পান না। এ জন্য তাঁকে জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নানা তথ্য–প্রমাণ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করতে হয়। এরপর সেই তথ্য-উপাত্ত সঠিক কি না, তা যাচাই করে থাকে পুলিশ বিভাগের বিশেষ শাখা। এই প্রেক্ষাপটে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়ার খবরটি আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। এদের বেশির ভাগই গেছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। ওই সব দেশে গিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের অনেকে নানা অপরাধকাজে লিপ্ত হচ্ছে, যার দায় পড়ছে বাংলাদেশের ওপর।
জালিয়াতির কারণে বাংলাদেশের হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশে আপত্তি ওঠায় সরকার কয়েক বছর আগেই যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) চালু করে। কিন্তু তাতে জালিয়াতি যে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, তার প্রমাণ রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট সংগ্রহ। পাসপোর্ট করতে গিয়ে কিংবা সীমান্ত পার
হতে গিয়ে যেসব ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা ধরা পড়ছে, সেসব ঘটনাই কেবল
গণমাধ্যমে আসছে। যারা ধরা পড়ছে না, তারা খাঁটি বাংলাদেশি হিসেবেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
প্রথম আলোর খবরমতে, এমআরপি নিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় ৬ জুলাই চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অভিবাসন পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে ধরা পড়েন পাঁচ রোহিঙ্গা তরুণ। তঁারা কেউই বাংলাদেশের নাগরিক নন। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও স্বীকার করেছেন, ‘ভুল তথ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা হরহামেশা পাসপোর্ট নিচ্ছে। এটা ঠেকানো যাচ্ছে না।’ আর এই কাজে তারা আঞ্চলিক অফিসগুলোই ব্যবহার করছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে থাকা নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬। তাদের নাম-ঠিকানা, ছবি ও আঙুলের ছাপ নিয়ে সরকার তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে। কিন্তু নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের তথ্যভান্ডার এখনো পাসপোর্টের মূল সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত না করা রহস্যজনক।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর উপর্যুপরি হামলায় টিকতে না পেরে গত বছর প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সংখ্যায় কম হলেও এদের একাংশ বাংলাদেশের জনসমাজে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এর আগে আসা রোহিঙ্গাদের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী? প্রথমত, রোহিঙ্গাদের জন্য যেসব শরণার্থী শিবির করা হয়েছে, সেখানেই তাদের চলাচল সীমিত রাখা; তারা যাতে কোনোভাবেই বাইরে এসে নিজেদের বাংলাদেশি নাগরিক দাবি করতে না পারে। দ্বিতীয়ত, যেসব স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পাসপোর্ট অফিস ও পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। অন্যায় করে কেউ পার হয়ে গেলে নতুন অন্যায়ের পথ উন্মুক্ত হয়। তৃতীয়ত, সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক বা হাতের ছাপসহ পরিচয়পত্র দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা প্রত্যেক শরণার্থীর জন্য নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে কোনো শরণার্থী বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট করতে সক্ষম হবে না।
আশা করি, বিলম্বে হলেও সংশ্লিষ্টদের বোধোদয় হবে।