সমাজতন্ত্রের ফিরে আসা

বার্নি স্যান্ডার্স , আলেকসান্দ্রিয়া ওকাসিও
বার্নি স্যান্ডার্স , আলেকসান্দ্রিয়া ওকাসিও

কার্ল মার্ক্সের জন্মের দুই শ বছর পর একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটছে। যেসব দেশে মার্ক্সবাদের ঝান্ডা উঠেছিল, যেমন রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ, সেখান থেকে মার্ক্সের নামগন্ধ মুছে যাওয়ার উপক্রম। কমিউনিজম কেন, সমাজতন্ত্র নামটা পর্যন্ত তারা ঘষে ঘষে মুছে ফেলছে। অথচ যেসব দেশে মার্ক্সবাদকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য কামান-বন্দুক, মায় পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখানে মার্ক্সবাদ শুধু তরতাজাই নয়, রীতিমতো মচমচে নতুন জুতো পরে হনহন করে হেঁটে চলেছে।

উদাহরণ হিসেবে এই আমেরিকার কথা ধরুন। কয়েক বছর আগেও সমাজতন্ত্র কথাটা জনসমক্ষে বলার আগে আপনাকে ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখতে হতো। ২০১৫-১৬ সালে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের অভাবিত রাজনৈতিক উত্থানের ফলেই বলুন আর ধনতন্ত্রের গভীর সংকটের জন্যই বলুন, এখন এ দেশের ক্রমবর্ধমানসংখ্যক মানুষ, বিশেষত তিরিশ বছর কম বয়সী ‘নব–সহস্রাব্দ নাগরিক’দের অনেকেই নিজেদের সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে মোটেই বিব্রত হয় না। ডেমোক্রেটিক পার্টির ৫৬ শতাংশ সদস্য এখন নিজেদের সমাজতন্ত্রের সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেন, এ কথা জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। এর চেয়েও আগ্রহোদ্দীপক পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জাতীয় জরিপ থেকে। দুই বছর আগের এই জরিপ অনুসারে আমেরিকার ১৮-২৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ৫১ শতাংশ জানিয়েছে, তারা ধনতন্ত্রের সমর্থক নয়। প্রকৃতপক্ষে ধনতন্ত্রের সমর্থক মানুষের সংখ্যা মাত্র ৪২ শতাংশ।

আমেরিকায় ধনতন্ত্রের মৃত্যু বা সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আসন্ন—এই পরিসংখ্যান থেকে অবশ্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যে বয়সী মানুষদের মতামতের ভিত্তিতে ধনতন্ত্রের মৃত্যু ঘোষিত হচ্ছে, সব দেশে সব সময়ই তারা সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে। বয়স যত বাড়ে, টাকাকড়ির প্রতি নজর তত বৃদ্ধি পায়, ধনতন্ত্র থেকে ফায়দা আদায়ে আগ্রহ জন্মে।

আমেরিকার রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটছে। এই প্রবণতার একদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান, অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বামপন্থীদের বাড়তি প্রভাব। নিজেদের মধ্যপন্থী বা ‘মডারেট’ বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন, এমন মানুষের সংখ্যা রিপাবলিকান পার্টিতে এখন পাঁচ আঙুলে গোনা যাবে। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যাঁরা নিজেদের মধ্যপন্থীর বদলে প্রগতিশীল বা ‘প্রগ্রেসিভ’ নামে পরিচয় দেন, তাঁদের সংখ্যা কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে দলের তিন-চতুর্থাংশের বেশি। তাঁদের কেউ নিজেদের উদারনৈতিক বা লিবারেল, কেউ প্রগতিশীল বা প্রগ্রেসিভ বলে মনে করেন। পিউ রিসার্চ, যারা প্রতিবছর এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক পক্ষপাত নিয়ে জরিপ চালিয়ে থাকে, তাদের ধারণা, উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল—এই দুটি শব্দ বদলাবদলি করা যায়। অর্থাৎ তারা ‘ইন্টারচেইঞ্জেবল’। যে উদারনৈতিক, সে–ই লিবারেল। এদের কেউ এই দুই শব্দের মধ্যে কোনো রকম প্রভেদ দেখে না।

মার্ক্সবাদের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে গোড়ায় যে কথা বলেছি, তা বোঝার জন্য লিবারেলিজমের এই গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রাখা ভালো। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার পর থেকেই ধনতন্ত্রের সংকট বিষয়ে মানুষের সচেতনতা অনেক বেড়েছে। কারণ, তারা নিজেরাই এই সংকটের শিকার। এটা এখন পরিষ্কার যে পুঁজিবাদের যে সংকট, তার চরিত্র শুধু চক্রাকার বিবর্তন নয়, তা কাঠামোগত। পুঁজি ও মুনাফা—এই সমীকরণের ভিত্তিতে যে ব্যবস্থার গঠন, তাতে সমাজের তলানিতে যারা রয়েছে, তারাই সর্বদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের সব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই মোট সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মানুষের সংখ্যা যদি হয় মোটে ১ শতাংশ, তো ক্রমাগত পিছু হটছে, এমন মানুষের সংখ্যা ৯৯ শতাংশ। এই ১ শতাংশে অব্যাহত আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই গড়ে উঠেছিল ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট’।

অকুপাই আন্দোলন মিইয়ে গেছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন বার্নি স্যান্ডার্স নন, ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ কথার অর্থ এই নয় যে রাজনীতিতে ও মানুষের চিন্তাভাবনায় এই আন্দোলন কোনো অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারেনি। বস্তুত, মাত্র পাঁচ-সাত বছরের ব্যবধানে আমেরিকার রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে ধনতন্ত্রের অব্যাহত সংকট। এত দিন এক বার্নি স্যান্ডার্স নিজেকে কোনো রাখঢাক ছাড়া সমাজতন্ত্রী বলতেন। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে নিজেদের সোশ্যালিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলের মনোনয়ন ছিনিয়ে নিয়েছেন, এমন প্রার্থীর সংখ্যা কয়েক ডজন। তাঁদের কেউ কংগ্রেসে, কেউ অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে আইনসভায়, কেউ স্থানীয় পরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের অনেকেই ডেমোক্রেটিক পার্টির পাশাপাশি নিজেদের ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য অথবা সমর্থক হিসেবে উপস্থিত করছেন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই। এক পেনসিলভানিয়াতে এই দলের তিন সদস্য রাজ্য আইনসভার মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন। ২০১৬ সালেও এই দলের সদস্যসংখ্যা ছিল ৭ হাজার, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজারে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো নিউইয়র্কে মাত্র ২৮ বছর বয়স্ক আলেকসান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোরতেসের মার্কিন কংগ্রেসের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বের নির্বাচনে সব হিসাব ওলটানো বিজয়। আলেকসান্দ্রিয়া যে আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন, তাতে ১৯ বছর ধরে সমাসীন রয়েছেন দলের প্রভাবশালী নেতা জোসেফ ক্রাউলি। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগেও আলেকসান্দ্রিয়া ব্রঙ্কসের এক বারে পরিচারিকার কাজ করতেন, তাঁর নির্বাচন করার মতো অর্থ থাকার প্রশ্নই ওঠে না। শুধু ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে পাঁচ-দশ ডলার করে চাঁদা তুলে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল, নির্বাচিত হলে তিনি ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা’ কর্মসূচির জন্য লড়াই করবেন। গত নির্বাচনে বার্নি স্যান্ডার্স এই ‘সমাজতন্ত্রী’ কর্মসূচি দিয়ে সবার নজর কেড়েছিলেন। আর আলেকসান্দ্রিয়ার বিরুদ্ধে ১৫ লাখ ডলার খরচ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি ক্রাউলি।

এমন অভাবিত ঘটনা ব্যাখ্যা করব কীভাবে?

একটা কারণ অবশ্যই ট্রাম্প। ট্রাম্পের বিজয়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী একটি গোষ্ঠীতন্ত্র বা অলিগার্কি ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। ট্রাম্প
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওয়াল স্ট্রিটের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করলেও ক্ষমতা গ্রহণের পর সেই ওয়াল স্ট্রিটের হাতেই ক্ষমতার চাবি তুলে দিয়েছেন। তাঁর অনুসৃত নীতির ফলে বর্ণবিদ্বেষ বাড়ছে, বাড়ছে নারী, বহিরাগত ও সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য। মধ্যবর্তী নির্বাচনে যে ট্রাম্পবিরোধী ‘নীল ঢেউ’র কথা বলা হচ্ছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে এই বৈষম্যের প্রতিবাদ। নারী, বহিরাগত ও সংখ্যালঘুরাই রয়েছে এই প্রতিবাদের সম্মুখসারিতে।

অন্য কারণ ধনতন্ত্রের ব্যর্থতা। বিশ্বের সব ধনবাদী দেশেই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে, কিন্তু আমেরিকায় এর গভীরতা অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে আমেরিকার সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ মানুষের বছরে গড়পড়তা আয় ১৬ হাজার ডলার, সেখানে দেশের সর্বোচ্চ ১ শতাংশের বার্ষিক গড়পড়তা আয় ১৩ লাখ ডলার। ৫০ বছর আগেও এই শীর্ষ ১ শতাংশের নিয়ন্ত্রণে ছিল দেশের ১০ শতাংশ সম্পদ। এখন তা বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এক আলেকসান্দ্রিয়া বা বার্নি স্যান্ডার্সের বিজয়ের ফলে আমেরিকায় সমাজতন্ত্র এসে যাবে, এ কথা বলি না। কিন্তু ধনতন্ত্রের পচনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে, এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না। আলেকসান্দ্রিয়া সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এই প্রতিরোধকে কোনো লেবেল সেঁটে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টার বিরুদ্ধে সচেতন থাকতে হবে। একে গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক, যে নামই দেওয়া হোক, সেটি একদম গৌণ বিষয়। এই প্রতিরোধের একটাই লক্ষ্য: মানুষে মানুষে বৈষম্য যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা।

মার্ক্সবাদের লক্ষ্যও তো ভিন্ন কিছু নয়। সে কারণেই ২০০ বছরের এই প্রবীণ মানুষটির কথা এখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি।

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি