টোপ দিয়ে বাঘের ছবি তোলা

বাঘ অত্যন্ত নিভৃতচারী প্রাণী। বিশাল নিবিড় বনভূমির কোন নিভৃতে কখন বাঘ বের হবে, আর আপনি তার ছবি তুলবেন—সেটা লটারি জেতার চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয়। সেটা বাম্পার সৌভাগ্যের বিষয় হয়, যখন এই ছবি তোলা যায় সুন্দরবনের মতো ঘন বুনটের জঙ্গলে। ভারতীয় সংরক্ষিত বনগুলোর মতো এখানে গাড়ি করে ঘুরতে ঘুরতে বাঘ দেখতে পাবেন না। নরম কাদার ওপর হাঁটতে হাঁটতে আপনি বাঘের কাছে পৌঁছানোর আগেই বাঘ পালিয়ে যাবে, নয় হামলে পড়বে। এখানকার নাব্য নদী ও খালগুলোই যাতায়াতের একমাত্র উপায়। আর অতি ভাগ্যবান হলে বাঘ আপনার সামনে দিয়ে পার হওয়ার সময় আপনি ছবি তুলতে পারবেন। আর না হলে আপনাকে টোপ দিয়ে আগে গেড়ে বসা মাচার সামনে বাঘকে আনতে হবে ছবি তোলার জন্য।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা বাঘ সম্পর্কে জানার জন্য সুন্দরবনে টোপ দেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৯৬৯ সালে গাই মাউন্টফোর্টের দল যখন সুন্দরবনে এ দেশের পশুপাখিদের রেকর্ড করতে আসে, তখন বাঘের জন্য টোপ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭০-৭১ সালে হিউবার্ট হেনরিশ যখন বাঘ নিয়ে গবেষণা করতে আসেন, তাঁরা ছাগল দিয়েছিলেন টোপ হিসেবে। বিশ্ববিখ্যাত বিড়াল-বিজ্ঞানী জর্জ শেলর ভারতের মধ্যপ্রদেশের ‘কানহা’র বনে বাঘ গবেষণায় এসেছিলেন ১৯৬৬ সালে। শেলরও সেখানে গরু টোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণের কাজ করেছেন। ১৯৮৫ সালে টেসা ম্যাকগ্রেগর নামের একজন প্রাণিবিদ বাঘের ছবি তুলতে গরু টোপ দিয়েছিলেন। টেসা ১৯৯৯ সালে আবার আসেন লন্ডনের সিকাডা ফিল্মসের পক্ষ থেকে ইন সার্চ অব ম্যানইটার ডকুফিল্মটি করার জন্য। ২০০০ সালে মাইক হার্ড গরু টোপ দিয়ে দ্য সোয়াম্প টাইগার ছবিটি করেন। ২০০৩ সালে রাজিয়া কাদির গরু টোপ দিয়ে বাঘের ছবি তোলেন।

এত উদাহরণ টানা হলো টোপ দিয়ে বাঘের ছবি তোলার ঐতিহাসিক পরম্পরা বোঝাতে। রাজিয়া কাদিরের ছবিটির সময় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়েকজন প্রাণিবিদ বাঘের ছবি তুলতে টোপ ব্যবহারের সমালোচনা করেন। বছর দুয়েক আগে টোপ দিয়ে বাঘের ছবি তুলতে আমেরিকান একটি দল বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। এমনিতেই বাংলাদেশের হীনবল পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নানাবিধ সমস্যার মধ্যে থাকে। বিভিন্ন মহলের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে মন্ত্রণালয় তাদের অনুমতি দেয়নি।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমান সময়ে দেশে বন্য প্রাণী বিষয়ে সচেতনতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। এত সংবাদপত্র, এত টেলিভিশন চ্যানেল! প্রচারমাধ্যম সংখ্যায় যত বেড়েছে, জ্যামিতিক হারে বাড়ছে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা। বাড়ুক, তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে একটি বিষয়ের নানা দিক বিবেচনায় না নিয়ে কোনো অবস্থান নেওয়া। টোপ দিয়ে বাঘের ছবি তোলার বিষয়ে বিরূপ মন্তব্যকারীরা জানেনই না কীভাবে কাজটি করা হয়! বারকয়েক আমার সৌভাগ্য হয়েছিল টোপ দিয়ে বাঘের ছবি তোলার সহযোগী হওয়ার। সেই আলোকে পাঠকদের জানাতে চাই কীভাবে কাজটি হয়।

সুন্দরবনে ছোট খাল বা নদীর পাড়ে জোয়ার সীমার চেয়ে উঁচু করে বাঁশ ও গোলপাতা দিয়ে মাচা করা হয় এমন জায়গায়, যেখানে বাঘের যাতায়াতের চিহ্ন রয়েছে। মাচার সামনে খোলা জায়গাটার লতাপাতা এমনভাবে ছাঁটা হয়, যাতে বাঘের সন্দেহ না হয়। এরপর খোলা জায়গাটায় গুলি করে মারা একটা গরু রাখা হয়। গরুটার শরীরের বিভিন্ন অংশে দড়ি বেঁধে মাটিতে পোঁতা খুঁটির সঙ্গে আটকে দেওয়া হয়, যাতে বাঘ গরু সরিয়ে নিতে না পারে। ছাগলের বদলে গরু দেওয়া হয় এ জন্য যে ছাগলকে যত শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা হোক না কেন, বাঘ সেটা হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে নিয়ে চলে যায়। আলোকচিত্রী ছবি তোলার সুযোগও পান না। গরুর মাংস বেশি, বাঘ দুই-তিন দিন ধরে বিভিন্ন সময়ে সেটা খায়। মাচায় লুকিয়ে আলোকচিত্রী এভাবে বাঘের নানাবিধ আচরণের ছবি তুলতে পারেন।

অনেকে বলে থাকেন, বনের বাঘকে বাইরের মাংস দেওয়া হলে বাঘের ক্ষতি হয়। তাঁদের উদ্দেশে বলছি, আপনারা সুন্দরবনে কিছুকাল কাটান, পর্যবেক্ষক হয়ে দেখুন—বুঝবেন আপনাদের ধারণা কত ভুল! সুন্দরবনের লোকালয়ের গরু, মহিষ, কুকুর, শূকর, ছাগল অসুস্থ হয়ে মারা গেলে এদের
শব ভাটির নদী-খালে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো ভাটিতে যেতে যেতে নতুন জোয়ার এলে বনের গাছপালায় আটকে যায়। বনের গুইসাপ, শূকর, বাঘ এগুলোর সদ্ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের কোনো ক্ষতি হতে দেখা যায়নি।

প্রশ্ন হতে পারে, বাঘের ছবি তুলতে হবে কেন? এর উত্তর হচ্ছে, এখনকার সময় প্রচারই প্রসার। গাই মাউন্টফোর্ট ১৯৭০ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ দেখে তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, যদিও বন বিভাগ আমাকে জানাচ্ছে, এখানে তিন শ বাঘ আছে, কিন্তু এখানে শতাধিক বাঘ আছে বলে মনে হয় না।

সুন্দরবনের ভূমি গঠনের অস্থিতিশীলতা, বাঘের মানুষ খাওয়ার প্রবণতার দুর্নাম আর মাউন্টফোর্টের লেখা পড়ে বিশ্ব সংরক্ষণবাদী সম্প্রদায় সুন্দরবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। ২০০০ সালে সোয়াম্প টাইগার ছবিটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যানেলে দেখানো হলে সুন্দরবনের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায় আবার আগ্রহী হয়ে ওঠে। ছবিতে এক ফ্রেমে পাঁচটি বাঘ দেখানো হলে সুন্দরবনের বাঘের অস্তিত্ব সগৌরবে প্রকাশিত হয়। সে সময় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় যদি টোপের অনুমতি না দিত, তাহলে সুন্দরবনের বাঘের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা সন্দিহান হয়ে পড়তাম।

আজও আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসে বা বাঘসংক্রান্ত খবরাখবর বিভিন্ন চ্যানেলে দেখানো হলে বিনা অনুমতিতে দ্য সোয়াম্প টাইগার-এর বিভিন্ন কাটপিস ব্যবহার করা হয়। কারণ, আর কারও কাছেই সুন্দরবনের চলমান বাঘের ফুটেজ নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ভারতের রানথামবার, বান্ধবগড়, কানহার, কাজীরাঙ্গার আবেদন অনেক বেশি। রানথামবারে তো প্রতিবছরই বাঘের ওপর চলচ্চিত্র তৈরি করা হচ্ছে। এর থেকে আয় হচ্ছে কোটি কোটি রুপি। প্রচার পাচ্ছে বাঘ সংরক্ষণের বিষয়টি। আমাদের সুন্দরবন ও সুন্দরবনের বাঘকে সংরক্ষণ করতে বাঘকে প্রচারে রাখতে হবে। এ জন্য বাঘের ছবি তোলা দরকার।

বন বিভাগকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, এই অনুমতি যেন কোনোমতেই অভয়ারণ্য এলাকায় দেওয়া না হয়। আরেকটি বিষয়ে লক্ষ রাখা দরকার, টোপের জন্য দেওয়া গরুগুলো যেন বন বিভাগ পরীক্ষা করে দেয়।

খসরু চৌধুরী বন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ