আত্মার আত্মীয় শৈলজারঞ্জন মজুমদার

শৈলজারঞ্জন মজুমদার
শৈলজারঞ্জন মজুমদার

শৈলজারঞ্জন মজুমদার। তাঁকে নিয়েই আজকের কথা। তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে যে কজন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ বা সংগীতশিল্পী জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ভুবনের তারকা শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নাম অপ্রতিরোধ্যভাবে সামনে এসে পড়ে। তিনি জন্মেছিলেন আমার জন্মস্থান নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে।

১৯০০ সালের ১৯ জুলাই তিনি তদানীন্তন নেত্রকোনা মহকুমার মোহনগঞ্জ থানাধীন বাহাম গ্রামে এক কুলীন হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল এলাকার জমিদার। স্বভাবতই আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন শৈলজারঞ্জন। তাঁর বাবা রমনী কিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন নেত্রকোনা মহকুমার সেই সময়ের ডাকসাইটে উকিল। মায়ের নাম সরলা সুন্দরী মজুমদার। প্রখ্যাত সাহিত্যিক নিরদ সি চৌধুরী ছিলেন তাঁর বাবার মামাতো ভাই। নিরদ সি চৌধুরীর বাড়িতেই প্রথম রবিবাবুর গান শোনেন। এরপর শুরু হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর নিয়মিত পদচারণ। ১৯৩২ সালে তিনি শা‌ন্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে যোগ দেন রসায়নশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে। একপর্যায়ে সরাসরি কবিগুরুর সান্নিধ্য লাভ এবং কালক্রমে তাঁর সৃষ্ট ‘সংগীত-ভবনের’ দায়িত্ব নিয়ে অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার।

আজ শৈলজারঞ্জনের মতো বড় একজন মানুষের জীবন নিয়ে লেখার অনেকেই আছেন। তাঁদের তুলনায় আমি নিতান্তই বেমানান। তাঁর জীবনের সবকিছু জানা বা দেখার সুযোগও আমার হয়নি। তবে শৈলজাবাবুর জীবনের শেষ পর্বে তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে তাঁকে জানার ও দেখার কিছু স্মৃতির পাতা আজও উজ্জ্বল। আজ তাঁর জন্মদিনে সেগুলোর মধ্যেই কিছুটা ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টায় এই লেখা।

শৈলজাবাবুকে নিয়ে আমার স্মৃতিপটে এখনো অনেক কিছু অমলিন। যত দূর মনে পড়ছে, ১৯৭৪ সালে শৈলজাবাবু একবার তাঁর জন্মভিটা মোহনগঞ্জের বাহাম গ্রামে এসেছিলেন। চৈত্র-বৈশাখের এক সকালে সম্ভবত বেলা ১১টার পর রোদ গায়ে জড়িয়ে মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলেছেন শৈলজাবাবু তাঁর জন্মভিটার পানে।

জন্মভিটা বাহাম গ্রামে পৌঁছেই শৈলজারঞ্জন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁর বাড়িতে তখন উদ্বাস্তুরা বাস করছিলেন। তাঁরা তাঁকে ডাবের পানি পান করান। জন্মভিটার মাটি নিজ কপালে মেখে তিনি বলেছিলেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।’ আফসোসের সুরে তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমি নিজের জন্মভূমি থেকে কত দূরে অবস্থান করছি!’ নিজ জন্মভূমিতে আচমকা দীর্ঘদিন পর এসে শৈলজাবাবুর এ অনুভূতি ও কথাগুলো জেনেছি আমার বাবার কাছ থেকে। আমার বাবা এখন প্রয়াত।

শৈলজাবাবু সম্ভবত দুই রাত আমাদের বাসায় অবস্থান করেছিলেন। আমার মা ওই দুই দিনেই তাঁর খুব ভক্ত হয়ে ওঠেন। আমার মায়ের বাবা ও শৈলজাবাবুর জন্ম একই সালে। সে জন্যই বোধ করি আমার মা পরম পিতৃশ্রদ্ধায় তাঁর সেবা করার চেষ্টা করছিলেন। শৈলজাবাবু আমার বাবা ও মাকে একসময় বললেন, ‘আমি তোমাদের আপন মানুষ, তোমাদের আপনি বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছা হয় না।’

এরপর তিনি আরেকবার বাংলাদেশে আসেন। ১৯৮৬ সালের শেষ ভাগে। সেবারও তিনি নেত্রকোনা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর বয়স ৮৬ বছর। নেত্রকোনা ডাকবাংলোয় এসে শৈলজাবাবুর পা স্পর্শ করে আমার বাবা, আমি ও আমার ছোট ভাই প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই। তিনি তখন খুব একটা ভালো দেখতে পেতেন না। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে এসেছিল। এ যাত্রায়ও আবার আমার বাবাকে কাছে পেয়ে শৈলজাবাবু বললেন, ‘আমি জানতুম তুমি না এসে পারবে না। আর তুমি না এলে আমি যেভাবেই হোক তোমাকে দেখতে তোমার বাড়িতে যেতুম।’ কী অপূর্ব বচন! এ যেন মাতৃভূমির প্রতি, জন্মভিটার প্রতি এক অকপট টানের প্রতিফলন। অমি বিস্মিত হই। এবারই আমি তাঁকে প্রথম দেখি। তিনি দুই হাত একত্র করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে আমায় আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। আমিও উকিল হয়েছিলাম, বাবারও ইচ্ছা ছিল আমি ওকালতি করব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আমি গুরুদেবের টানে সংগীতের দিকেই চলে গেলাম।’ আমাকে লক্ষ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রার্থনা করি, তুমি অনেক বড় একজন উকিল হও।’

কিছুক্ষণ পর শৈলজাবাবু এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে প্রাতরাশ সেরে সকাল নয়টার দিকে ডাকবাংলো থেকে বিদায় নিই। এভাবেই শৈলজারঞ্জন মজুমদার আমাদের পরিবারের খুব কাছের একজন মানুষ হয়ে ওঠেন। আমাদের মনের গহিনে তাঁর অবিরাম বসবাস। আমাদের আত্মার আত্মীয় ছিলেন তিনি। যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন, তত দিন তিনি আমার বাবার সঙ্গে পত্রে যোগাযোগ রেখে গেছেন। দীর্ঘদিন পর শৈলজারঞ্জন তাঁকে লেখা আমার বাবার একটি পত্র তাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থ যাত্রাপথের আনন্দগান-এ ছেপেছেন।

শৈলজারঞ্জন ১৯৮৬ সালে এসেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু তাঁকে তখনো আলোড়িত করে ছিল। এখনো শৈলজারঞ্জনের বাহাম গ্রামের বাড়িটির ব্যাপক অংশ উদ্বাস্তুদের দখলে। এ উদ্বাস্তুদের বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করে সেখানে তাঁর নামে একটি একাডেমি করা যায় কি না, তা ভেবে দেখার জন্য যথাযথ প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন ও স্থানীয় প্রশাসন সে লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। সাজ্জাদুল হাসান আমার মেজ ভাই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব। সম্প্রতি সে–ও শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মভিটা পরিদর্শন করেছে। এটি স্থানীয় জনগণের মনে এক আশার সঞ্চার করেছে। তারা ভাবছে, সম্ভবত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শৈলজাবাবুর বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে।

শৈলজারঞ্জনের জন্মভিটায় তাঁর নামে একটি একাডেমি করে সেখানে বিশুদ্ধ সংগীত ও সংস্কৃতিচর্চার আয়োজন নেত্রকোনা জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে। আর সেই সঙ্গে মোহনগঞ্জ হয়ে উঠবে দুই বাংলার রবীন্দ্রপ্রেমীদের এক সেতুবন্ধন ও মিলনক্ষেত্র। একজন রবীন্দ্রপ্রেমী হিসেবে এটি আমারও চাওয়া। আমাদের আত্মার আত্মীয় কবিগুরুর পরম স্নেহাস্পদ ও আস্থাভাজন বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীতচর্চার অন্যতম ধারক শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ১১৮তম জন্মদিনে তাঁর আত্মার শা‌ন্তি কামনা করছি। শৈলজাবাবু চিরকাল আমাদের অন্তরে বিরাজিত থাকবেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি