সুইস ব্যাংকে সব টাকাই কালো নয়!

বছর ঘুরে আবার সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের নতুন হিসাব পাওয়া গেল। প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৭’ প্রতিবেদন অনুসারে গত বছর দেশটির ব্যাংকগুলোয় (যা সাধারণত সুইস ব্যাংক হিসেবে পরিচিত) বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত তহবিল তার আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ কমে গেছে। এটি সুখবরই বটে! আপাতত মনে হচ্ছে, দেশ থেকে পাচার করে সুইস ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখার প্রবণতা কমেছে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ পুরোটাই দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ নয়, তা বলা গেলেও কতটা পাচার হওয়া অর্থ, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে জানা কঠিন। ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডের এই বার্ষিক প্রতিবেদন এ কথা বলে না যে কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে বা পাচার হয়ে দেশটির ব্যাংকগুলোয় ঢুকেছে। এটি বরং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ লেনদেন ও গচ্ছিত থাকার বার্ষিক হিসাব প্রকাশ করে। কিন্তু সুইস ব্যাংকগুলোর বৈশিষ্ট্যই হলো তারা গ্রাহকের যাবতীয় তথ্য গোপন রাখবে, গ্রাহক কোথা থেকে এবং কীভাবে টাকা এনে জমা করছেন, তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না বা জানা থাকলেও তা প্রকাশ করবে না। জামানতকারীর পরিচয় কোনোভাবেই প্রকাশ করবে না। যুগের পর যুগ এই আইনসিদ্ধ গোপনীয়তার কারণেই কর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারকারীরা সুইস ব্যাংকগুলোকে বেছে নিয়েছেন। এ কারণে সুইজারল্যান্ডও হয়ে উঠেছে কর ফাঁকির এক স্বর্গরাজ্য বা করের নিরাপদাবাস, যাকে বলে ট্যাক্স হেইভেন (হ্যাভেন বা স্বর্গ নয়)। ফলে, সুইস ব্যাংকগুলোয় গচ্ছিত অর্থের বড় অংশই সাধারণভাবে পাচার হওয়া অর্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে পুরোটা কর ফাঁকি দেওয়া কালোটাকা বা পাচারকৃত নয়।

২০১৩ সালে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা থাকার খবর প্রকাশিত হয়। তবে ২০১৪ সালে একাধিক গণমাধ্যমে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের বা বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট অর্থ গচ্ছিত থাকার প্রতিবেদন ফলাও করে প্রকাশিত হয়। এর জের ধরে সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা নিয়ে জাতীয় সংসদে বেশ কথাবার্তা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংক থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু তৎপরতা দেখায়। তারা সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হিসেবে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেয়। পরবর্তী সময়ে এগুলোর কোনোটিই আর কার্যকর হয়নি।

বরং গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ বিষয়ে এক নতুন বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। এর ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঘোষণা দেন, সুইস ব্যাংকে তেমন কোনো টাকা পাচার হয়নি বা সেখানে গচ্ছিত অর্থ কালোটাকা নয়। বরং দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের লেনদেন বাড়ায় সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ২০১৫ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়ে হয়েছিল প্রায় ৬৬ কোটি ৭৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এ তথ্য প্রকাশ হওয়ার অল্প পরেই অর্থমন্ত্রী তাঁর নতুন ব্যাখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে সামান্য কিছু টাকা পাচার হতে পারে অথচ গণমাধ্যম ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তা উপস্থাপন করছে।

অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ব্যাখ্যা উপাত্তনির্ভর হলেও এর পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েই গেছে। প্রথমত, যদি সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট গচ্ছিত অর্থের ৯৩ শতাংশ বা প্রায় পুরোটাই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেন-সংশ্লিষ্ট অর্থ হবে, তাহলে তা বুঝতে ও নির্ণয় করতে চার বছর লাগল কেন? সেই ২০১৪ সালে যখন সুইস ব্যাংকের অর্থ নিয়ে হইচই হলো, তখনই তো তা খতিয়ে দেখে সবাইকে জানানোর কথা। দ্বিতীয়ত, যদি গচ্ছিত অর্থের প্রায় পুরোটাই বাণিজ্যিক লেনদেনের হয়, তাহলে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি তাঁদের বৈধ অর্থ সুইস ব্যাংকে রাখছেন, সেগুলো কোথায় গেল? কেননা, অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের বৈধ অর্থও সুইস ব্যাংকে জমা রেখে থাকে। তৃতীয়ত, সুইজারল্যান্ডের থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা নিয়ে নানামুখী উদ্যোগ ও তৎপরতার কথা কেন বছরের পর বছর প্রচার করা হলো? পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার কাজটি খুব সহজ নয়, তা তো সবারই জানা। চতুর্থত, সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের বিষয়ে কোনো কূলকিনার করতে না পেরে তেমন কোনো টাকা পাচার হয়নি—এ রকম একটি প্রচারণা দিয়ে কি পুরো বিষয়কে অন্যদিকে ঘোরানোর কোনো প্রয়াস নেওয়া হয়েছে?

এবার অবশ্য এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের হালনাগাদ হিসাব নিয়ে অর্থমন্ত্রী কিছু বলেননি। আর তাই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় এই অর্থ কমেছে কি না, তাও জানা যায়নি। অথচ ২০১৭ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৪ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৬৭ দশমিক ৬৮ কোটি সুইস ফ্রাঁয় উন্নীত হয়েছে, ২০১৬ সালে যা ছিল ৫৯ দশমিক ১৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ। আর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে আছে আমদানির তুলনায় রপ্তানি বেশি হওয়ার কারণে। যদি বাণিজ্য বাড়ার কারণে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট গচ্ছিত অর্থ বাড়ে, তাহলে গত বছর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ার পরও এই অর্থ কমে গেল কেন?

প্রতিবেশী ভারতের অর্থমন্ত্রী সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের টাকা নিয়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে অনেকটাই যেন গলা মেলালেন। ২০১৭ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থ ৫০ শতাংশ বেড়েছে। তার আগের তিন বছর ক্রমাগত কমার পর এই বৃদ্ধি ভারতীয় গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হয়েছে। এই নিয়ে দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস মোদি সরকারকে ইতিমধ্যে একহাত নিয়েছে। তবে ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গয়াল বলেছেন, সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের সব টাকাই কালোটাকা, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। আর চিকিৎসাজনিত বিশ্রামে থাকা (অর্থমন্ত্রী) অরুণ জেটলি তাঁর ব্লগে লিখেছেন, সুইস ব্যাংকে টাকা জমা হওয়া মানেই তা কালোটাকা নয়। ভারতীয় মন্ত্রীদের আরও দাবি, সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে ২০১৯ সাল থেকে দেশটি ভারত সরকারকে সুইস ব্যাংকে যেসব ভারতীয় অর্থ গচ্ছিত রাখছেন, তাঁদের তথ্য দেবে। এটা জানার পর কেউ পাচার করে বা কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ নিয়ে গিয়ে সেখানে রাখবেন না। তাহলে এখন কোন ভারতীয়রা সুইস ব্যাংকে টাকা রাখছেন? জেটলির জবাব হলো, গচ্ছিত টাকার বড় অংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত অন্য দেশের নাগরিকদের এবং অনাবাসী ভারতীয়দের। এর সঙ্গে গয়াল যোগ করেছেন, ভারতীয়রা যাঁরা বিদেশে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর সুযোগ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের টাকাও আছে।

ভারত সরকার তারপরও সুইস ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে একটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের চাপে সুইজারল্যান্ড তাদের ব্যাংক গোপনীয়তা আইনেও কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। এতে করে দেশটির ব্যাংকগুলোয় আগের মতো নিশ্চিন্তে পাচার করা টাকা জমা রাখার সুযোগও কমে গেছে। সে কারণে সার্বিকভাবেই বিদেশিদের অর্থ জমা রাখার প্রবণতায় আপাতত কিছু পরিবর্তন আসছে। বরং অনেকেই দুবাই, সিঙ্গাপুর, সিশেলস বা পানামায় অর্থ রাখা অধিক নিরাপদ মনে করছেন। অবশ্য পানামা ফাঁসের (পানামা লিকস) পর সেখানেও আর আগের মতো নিশ্চিন্ত টাকা রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে সাময়িকভাবে অনেকে টাকা সরিয়ে নিলেও আবার তা সুইস ব্যাংকে ফিরিয়ে আনছেন। ভারতীয়দের বেলায় এ রকম কিছু ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। অনেক ভারতীয়ই তাঁদের অর্থ সুইজারল্যান্ড থেকে সরিয়ে দুবাই, সিঙ্গাপুর বা সিলশসে নিয়ে গিয়েছিল। এসব জায়গায় নামসর্বস্ব কোম্পানিতে বিনিয়োগও করা হয় এই অর্থ। এখন সেই বিনিয়োগকৃত অর্থ যদি আবার নতুনভাবে সুইস ব্যাংকে এসে জমা হয়, তাহলে তা কালো বলার কোনো সুযোগ নেই, অন্তত আইনের ভাষায়।

বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এভাবে সুইস ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার কারণে ২০১৭ সালে সেখানে গচ্ছিত টাকা কমেছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই। একইভাবে সুইস ব্যাংকের কোনো বাংলাদেশি গ্রাহক যদি কোনো নামসর্বস্ব বা কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খুলে টাকা রেখে থাকেন, তা এই পরিসংখ্যানে উঠে আসেনি।

প্রকাশিত তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট টাকা সুইস ব্যাংকগুলোয় খুবই কম। তাই বলে টাকা পাচার হয় না বা পাচার একেবারেই কমে গেছে—এমনটা নিশ্চিত হওয়া যাবে না। কিন্তু সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া টাকার বিষয়টি হালকা করে দেখা বা প্রকারান্তরে টাকা পাচারের সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া কোনো ইতিবাচক বার্তা বহন করে না।

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক
[email protected]