ভয়মুক্ত নির্বাচন চান সিলেটবাসী

বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, আরিফুল হক চৌধুরী
বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, আরিফুল হক চৌধুরী

সিলেটের এক বন্ধু ঠাট্টা করে বললেন, এখানে রান্নাঘরের চেয়ে রেস্তোরাঁ বেশি। মানুষ হোটেলে খেতে বেশি পছন্দ করে। সিলেটে রেস্তোরাঁগুলোর নামও সুন্দর—পানসি, পাঁচ ভাই, ভোজনবাড়ি, সাম্পান ইত্যাদি। একেকটি রেস্তোরাঁয় শ খানেক মানুষ একসঙ্গে বসে খেতে পারেন। বাড়ি, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে এখন রেস্তোরাঁগুলোতে প্রার্থীরা গণসংযোগে নেমেছেন। কর্মীরা দিন শেষে সেখানে গিয়ে নৈশভোজ সারছেন।

বিমানবন্দর থেকে শহরে ঢুকতে রাস্তার দুই পাশে সাদা-কালো অসংখ্য পোস্টার। কোনোটি মেয়র প্রার্থীর, কোনোটি কাউন্সিলর প্রার্থীর। অনেক প্রার্থী সড়কের পাশে অস্থায়ী নির্বাচনী অফিস খুলে বসেছেন।

খুলনা ও গাজীপুরে দেখেছি একজন মেয়র প্রার্থীর পোস্টারের আধিপত্য। এখানে নৌকা ও ধানের শীষ—দুই মেয়র প্রার্থীর পোস্টারই শোভা পাচ্ছে। 
তবে নৌকার সংখ্যা বেশি। সহকর্মী সাংবাদিক সুমনকুমার দাশকে জিজ্ঞেস করি, কেউ কারও পোস্টার ছেঁড়েন না। তিনি বললেন, এখানে পোস্টার ছেঁড়ার চেয়ে কাটার প্রবণতা বেশি। কারও পোস্টার পেছনে পড়ে গেলে তাঁর সমর্থকেরা সামনের পোস্টারটি কেটে ফেলেন।

সোমবার রাত সাড়ে আটটা। মির্জাজাঙ্গালে অবস্থিত আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের নির্বাচনী অফিস। ভেতরে নেতা-কর্মীদের ভিড়। নেতারা প্রচারকাজ তদারক করছেন। কর্মীরা তাঁদের নির্দেশ–উপদেশ নিচ্ছেন।

আলাপ হলো জেলা দপ্তর সম্পাদক জগলু চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে। কামরান তখন গণসংযোগে বাইরে ছিলেন। জানতে চাই, নির্বাচনের পরিবেশ কেমন। জগলু চৌধুরী বললেন, পরিবেশ খুবই ভালো। এখানে কোনো ঝগড়া–বিবাদ নেই। সব দলই সুন্দরভাবে প্রচারকাজ চালাচ্ছে। তাঁকে বলি, কয়েক দিন আগে তো বিএনপির এক প্রার্থীকে থানায় আটকে রাখা হয়েছিল।

তিনি বললেন, এগুলো ‘মিডিয়ার ম্যানিপুলেশন’। প্রকৃত ঘটনা হলো বিএনপির এক কর্মী নৌকার পোস্টার ছিঁড়ছিলেন। সেই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী। তাঁরা জানতে চাইলেন, কেন তিনি পোস্টার ছিঁড়ছেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিতণ্ডা। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিএনপির ওই কর্মীকে পুলিশ ফাঁড়িতে সোপর্দ করেন। বিষয়টি জানতে পেরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী টেলিফোন করেন কামরান ভাইকে। এরপর তিনি ওসিকে টেলিফোন করে বিএনপির কর্মীকে ছেড়ে দিতে বলেন। এর আগেই বিএনপির প্রার্থী একটি চেয়ার নিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বসে পড়েন। এটি ছিল ওদের নাটক। তবে এই নাটকে আওয়ামী লীগের ভূমিকাও কম ছিল না।

সিলেট আওয়ামী লীগের এই নেতা আরও যোগ করলেন, কামরান ভাইয়ের পক্ষে গণজোয়ার উঠেছে। সিলেট শহরের যত উন্নতি, তা হয়েছে কামরানের আমলে। তা ছাড়া সিলেটের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির মেয়র থাকা সত্ত্বেও অনেক টাকা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উদার মানুষ। তিনি উন্নয়নে দল দেখেন না। অকাতরে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকাকালে মেয়র কামরানকে কোনো টাকাপয়সাই দেননি। তারপরও তিনি নগরের উন্নয়ন করেছেন।

জিজ্ঞেস করি, ভোটারদের মনোভাব কীভাবে আঁচ করলেন। তাঁর জবাব, কামরান ভাই হলেন গরিব মানুষের নেতা। আর তাঁর বিপক্ষে যিনি দাঁড়িয়েছেন, তিনি হলেন বড়লোকদের প্রতিনিধি। ভোটাররা বুঝে গেছেন, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনেও ক্ষমতায় আসবে। অতএব, কামরানকে মেয়র নির্বাচিত করলে সিলেটের মানুষ অনেক বেশি উন্নয়ন পাবে। দ্বিতীয়ত, বিএনপিতে বিরোধ আছে। আরিফুল হককে চ্যালেঞ্জ করে একজন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপি জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীও প্রার্থী দিয়েছে। ফলে তাদের ভোট ভাগ হয়ে যাবে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

২০১৩ সালে কামরান সাহেব হারলেন কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ওই সময়ে দল (আওয়ামী লীগ) এক ছিল না। তা ছাড়া নির্বাচনের আগে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের ঘটনা আমাদের বিপক্ষে যায়। এবার সেসব সমস্যা নেই। আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, অনেকে বলেন, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী নাকি আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’। তিনি আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘বি টিম’-এর রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরাই এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

এরপর কিছুটা উষ্মার সঙ্গেই জগলু চৌধুরী জানালেন, মিডিয়াকে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। বেঠিক কোথায় দেখলেন? তিনি বললেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের ছোটখাটো দুর্বলতা ও ত্রুটিকে বড় করে দেখে। সিলেটে সব প্রার্থী সুষ্ঠুভাবে প্রচারকাজ চালাচ্ছেন। অথচ গণমাধ্যম বিএনপির কর্মীর আটকের ঘটনাই বড় করে ছেপেছে। আরেক নেতা বললেন, প্রথম আলো সব সময় বিরোধী দলের ভূমিকা নেয়। তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি, বিএনপি আমলে প্রথম আলোর ভূমিকা কী ছিল? তিনি বললেন, বিএনপি আমলেও তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল। সত্য ভাষণের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অফিস থেকে আমরা চলে আসি।

প্রথম আলোর প্রদায়ক মানাউবী সিংহকে জিজ্ঞেস করলাম নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে এখন কোথায় লোকজন পাওয়া যাবে। তিনি বললেন, কিন ব্রিজে। সিলেটের বিখ্যাত সেতু। কবি দিলওয়ার কবিতা লিখেছিলেন ‘কিন ব্রিজে সূর্যোদয়’। রাতে ঝলমলে আলোয় কিন ব্রিজের ওপর শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। ব্রিজের দুই পাশেও অনেকে আড্ডা দিচ্ছেন। সেখানেই দেখা হলো বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে। তিনি ঘুরে ঘুরে ভোটারদের মতামত নিচ্ছিলেন। সবাই বলছেন, ‘আমরা ভালো নির্বাচন চাই।’ ‘ভয়মুক্ত নির্বাচন চাই।’

কিন ব্রিজের পাশে কথা হলো তিন তরুণের সঙ্গে। তাঁদের দুজন বেসরকারি ব্যাংকে এবং একজন একটি সরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। জানতে চাইলাম ভোট কেমন হবে। একজন বললেন, এখনো পর্যন্ত পরিবেশ ভালো আছে। কিন্তু এরপর এই পরিবেশ কদিন থাকবে, তাঁরা নিশ্চিত নন। তারপরও তাঁরা আশা রাখছেন, সিলেটে সুষ্ঠু ভোট হবে।

শহরের আরেক প্রান্ত কাজী টোলায় বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচনী অফিস। জিন্দাবাহার, বন্দরবাজার এলাকায় বেশ যানজট। নানা সড়ক ঘুরে আমরা রাত সাড়ে নয়টায় সেখানে যাই। একটি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে ধানের শীষের নির্বাচনী অফিস করা হয়েছে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা হয় ঢাকা থেকে আসা বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, আরিফ সিলেটের উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ করেছেন। শহরের জলাবদ্ধতা দূর করেছেন। সড়কগুলো প্রশস্ত করেছেন। মানুষ ভোট দিতে পারলে তিনিই জয়ী হবেন। জামায়াতের আলাদা প্রার্থী দেওয়ায় ভোটে তেমন প্রভাব ফেলবে না। আর এই প্রবীণ নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগের প্ররোচনায়ই বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন।

আমরা যখন আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচনী অফিসে যাই, তিনি তখন ভেতরেই। এতক্ষণ গণসংযোগে ছিলেন। নেতা–কর্মী–সমর্থকেরা তাঁকে ঘিরে আছেন। এরই মধ্যে আগামীকালের কর্মসূচি ঠিক করছেন। নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘পরিবেশ মোটামুটি ভালো। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে আমাদের পোস্টার ছিঁড়ে নৌকার পোস্টার লাগানো হচ্ছে।’

জিজ্ঞেস করি, নির্বাচন কমিশনে আপনারা অভিযোগগুলো জানিয়েছেন কি না। আরিফুল বললেন, ‘অভিযোগ করলেও কমিশন আমলে নিচ্ছে না। আবার আওয়ামী লীগ আমাদের অভিযোগ বন্ধ করতে একগাদা ভিত্তিহীন অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে পেশ করেছে।’

তাঁর সঙ্গে কথা বলে বাইরে আসতেই দেখি বেবিট্যাক্সিচালকদের জটলা। তাঁদের জিজ্ঞেস করি, আপনারা যাত্রী নিয়ে এসেছেন, না প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। তাঁরা বললেন, ‘দুটোই। আমরা যাত্রী নিয়ে এসেছি আবার আরিফ সাহেবকেও সমর্থন করি। তিনি শহরের রাস্তাগুলো প্রশস্ত করেছেন বলেই আমরা আরামে গাড়ি চালাতে পারছি।’

তাঁদের কথায় মনে হলো বেবিট্যাক্সিচালকেরাও এদলে–ওদলে বিভক্ত। যাঁরা বিএনপির সমর্থকদের আনা–নেওয়া করছেন, তাঁরা আরিফ সাহেবকেই ভোট দেবেন। আর যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আনা–নেওয়া করছেন, তাঁরা কামরান সাহেবকে ভোট দেবেন।

আগামীকাল: সিলেটে জামায়াতের নতুন কৌশল

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি