বীজ থাকতে কেন বীজসংকট?

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলে প্রায় দ্বিগুণ দামে আমন বীজ বেচাকেনার দুঃসংবাদ আসছে। অনেকের কাছে হয়তো এ খবরের কোনো গুরুত্ব নেই । কিন্তু চাষির কাছে এ খবর কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। বরগুনার আমতলী উপজেলার চাষিরা জানাচ্ছেন, সেখানে বিআর-২৩ আমন ধানের বীজের চাহিদা বেশি থাকায় ১০ কেজির প্যাকেট বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ৬৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, আমতলীর পাতাকাটা, বাঁধঘাটসহ সর্বত্র বীজধানের দাম চড়া; বীজের ডিলাররা ১০ কেজির বিআর-২৩ বীজ ৯৪০ থেকে ৯৫০ টাকা করে বিক্রি করছেন। সংবাদকর্মীরা একটি তালাবদ্ধ গুদাম থেকে ৪০ বস্তা আমন ধানের বীজও উদ্ধার করেছেন।

এ দিকে ঘূর্ণিঝড় সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সংকট আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সেখানে উপকূলীয় কৃষির উপযুক্ত জাতের ধান বিআর-১১, ৫২ ও ৪৯-এর চাষ হয়। কৃষকদের সুবিধার কথা ভেবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ভিত্তি ও প্রত্যয় মান-ঘোষিত এ তিন জাতের বীজ জুন মাসের মাঝামাঝি সময় সরকার-নির্ধারিত মূল্যে চাষিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চারজন ডিলার নিয়োগ করে। এ তিন জাতের মধ্যে বিআর ৪৯-এর কোনো চাহিদা নেই।

বেড়িবাঁধ সময়মতো মেরামত না হওয়ায় এবং জোয়ারের পানি আটকানোর কোনো উপায় না থাকায় অপেক্ষাকৃত উচ্চ ফলনশীল বিআর-৪৯ না নিয়ে প্রায় সবাই বিআর-১১, বিআর-৫২ ধানের বীজ সংগ্রহের চেষ্টা করায় ডিলাররা ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। তাঁরা এ দুই জাতের বীজ সরিয়ে ফেলেন। ফলে চাষিকে দিতে হয় বেশি দাম।

উপজেলার মঠেরপাড়, সাউথখালী, তাফালবাড়ী, ধানসাগর, কদমতলাসহ বিভিন্ন এলাকায় সংবাদকর্মীরা গেলে চাষিরা জানান, ১০ কেজি ওজনের উচ্চ ফলনশীল এক বস্তা বীজধানের দাম সরকারিভাবে ৫৫০ ও ৬২০ টাকা হলেও ডিলাররা বস্তাপ্রতি ৮০০, ১ হাজার ও ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম নিচ্ছেন। বীজধানের দাম নিয়ে প্রশ্ন করলে বা দামাদামি করলে ধান নেই বলে অনেক চাষিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়।

কেন এই সংকট?

একটু ঠান্ডা মাথায় ওপরের দুটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিশেষ বিশেষ জায়গায় বিশেষ বিশেষ বীজের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। শরণখোলায় বেড়িবাঁধ মেরামত হয়নি, তাই কৃষকেরা ঝুঁকি নিয়ে বিআর-৪৯-এর চাষে যাবে না। মোটা চাল হলেও তাঁরা বিআর-১১, বিআর-৫২ চাষ করবেন, বেড়িবাঁধ ঠিক হলে হয়তো পরের বছর বিআর-৪৯-এর চাষে যাবেন।

চিকন আর ভালো দামের বীজধান বিআর-৪৯ তখন পাওয়া যাবে না, কারণ বিএডিসি চলতি বছরের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পরের বছরের কোটা নির্ধারণ করে। বিএডিসি সূত্র জানায়, শরণখোলায় এ বছর বিআর-৪৯ জাতের সাড়ে ৩২ টন, ব্রি-৫২ জাতের সাড়ে ৫ টন এবং বিআর-১১ জাতের ১৩ টন ৮৫০ কেজি বীজধান সরবরাহ করা হয়েছে। ডিলাররা জানাচ্ছেন, বিআর-৪৯ বরাদ্দের সিকিভাগও তাঁরা বিক্রি করতে পারেননি।

স্থানীয় অবকাঠামো পরিস্থিতি, পরিবর্তিত আবহাওয়া, অন্যান্য ফসলের সঙ্গে সময়ের হিসাব, বাজারের হালচাল ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে চাষি ঠিক করেন তিনি কোন জাতের ধান লাগাবেন। বিএডিসির মোটা দাগের গড় হিসাবে প্রান্তিক চাষির প্রাণ রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়।

বীজের দাম বাড়ছেই

মাথাভারী সংগঠনের খরচ পোষানোর জন্যই হোক বা বেসরকারি বীজ উৎপাদকদের লাভের বস্তা ভরার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই হোক, গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে বিএডিসি সব ধরনের বীজের দাম বাড়িয়ে দেয়। গত আমন মৌসুমে যেখানে প্রতি কেজি প্রত্যয়িত ধানবীজের দাম ছিল ৩৫ টাকা। এখন তার দাম ৫০ টাকা এবং ৪০ টাকা কেজির ধানের বীজের মূল্য এখন ৫৮ টাকা। ৩৪ টাকা কেজির গমবীজের দাম দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকায়। সে হিসাবে মূল্যবৃদ্ধির হার ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশ।

অন্যান্য বীজের দামও একইভাবে বাড়ানো হয়েছে। যেমন মুগ ডালের প্রতি কেজি বীজের দাম ৫৮ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৪ টাকা। মাষকলাই ৮০ থেকে ৯০ টাকা, খেসারি ৪৮ থেকে ৬৪ টাকা, মটর ৫০ থেকে ৯৬ টাকা। তেলবীজের বেলায় সয়াবিন প্রতি কেজি ৫৪ থেকে ৬৮ টাকা, তিল ৪৫ থেকে ৬৮ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে।

শাকসবজির ক্ষেত্রে রতন জাতের টমেটোর বীজের দাম প্রতি কেজি ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ হাজার ৪১৫ টাকা। মুলার বীজের দাম প্রতি কেজি ১৬০ থেকে করা হয়েছে ১৮০ টাকা এবং লালশাকের বীজ ২৬০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৮০ টাকা।

তা ছাড়া, খরিপ ফসলের বীজের দামও বাড়ানো হয়েছে কেজি প্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা। কৃষকনেতাদের ধারণা, বিএডিসির বীজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আর্থিকভাবে কৃষক আরও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

কী বিকল্প হতে পারে?

কৃষক পর্যায়ে সংগঠিত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদন ধানের বীজের চাহিদার স্থায়ী সমাধান আর বীজের দামকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ-সংক্রান্ত যে কর্মসূচি আছে, সেটা বেগবান করার এটাই সময়। যে কৃষক ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারেন, যথাযথ সহযোগিতা পেলে তিনি উপযুক্ত ও টেকসই বীজও উৎপাদন করতে পারবেন। তা ছাড়া, কৃষক পর্যায়ে বীজ সংরক্ষণের ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে, কারণ পরবর্তী ফসল উৎপাদনের জন্য পূর্ণ জীবনীশক্তি নিয়ে বীজের গুণগত মান নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

সেই লক্ষ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের ওপর প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা জরুরি। কৃষকদের সচেতন করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বীজশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।

সাবেক চাষি ক্লাবগুলোকে উজ্জীবিত করে সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত গ্রামীণ তরুণ, নারী ও পুরুষদের নিয়ে নতুন আঙ্গিকে কাজ শুরু করতে হবে। গ্রামের যুব সম্প্রদায়কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন ও বীজ ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।

তা ছাড়া, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণ কার্যক্রমে নারী শ্রমিকের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে নারীশ্রমের উপযোগিতার ব্যবহার সম্ভব। এর ফলে যেমন নারীর ক্ষমতায়ন বেগবান হবে, অন্যদিকে পল্লি অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখবে। তা ছাড়া, স্থানীয় বাস্তবতাকে মাথায় রেখে বীজধান উৎপাদনে পারদর্শী কৃষকেরা ফলন বৃদ্ধি করতে পারবেন। কৃষকেরা উত্তরোত্তর আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।

গওহার নঈম ওয়ারা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক