ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার সরকারি অঙ্গীকার যে নিছক কাগুজে অঙ্গীকার নয়, তার দৃশ্যমান লক্ষণ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার। এটি একটি বৈশ্বিক প্রবণতা, বাংলাদেশ এর বাইরে থাকতে পারে না। বৈশ্বিক অগ্রগতির এই ধারায় আমাদের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যেতে পারত, যদি সরকার এই খাতের উন্নয়নকে অন্যতম জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ  না করত।

সরকারি উদ্যোগের ফলে তথ্যপ্রযুক্তি নেটওয়ার্কের সংযোগ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে; প্রতিটি ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। এর মাধ্যমে প্রান্তিক বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মোবাইল ব্যাংকিংসহ সব ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিসেবার আওতাভুক্ত হয়েছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে; নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকার কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ বেড়ে চলেছে। প্রকট বেকারত্বের এই দেশে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের সুবাদে সৃষ্ট এই অনুকূল পরিবেশ নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে।

লক্ষ করা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্সের ব্যাপক ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ, আন্তর্জাতিক মূল্য প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ, অভ্যন্তরীণ বাজারব্যবস্থার উন্নয়ন ও দক্ষতা বাড়ানো এবং স্বল্প খরচে লেনদেনসহ নানা রকমের সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিল্পের বিকাশ, রপ্তানি উন্নয়নসহ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারিত হচ্ছে এমন সব খাতে অধিকতর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স বা ডিজিটাল প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষম উন্নয়ন, সুব্যবস্থাপনা, নজরদারি নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা বেশ আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। অবশেষে সেই অভাব দূর হলো। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা’ অনুমোদন পেয়েছে। নীতিমালার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সরকারের ‘ভিশন ২০২১: ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সম্পর্কিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ডিজিটাল কমার্সের কোনো নির্ধারিত সংজ্ঞা ছিল না। এই নীতিমালায় একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে এভাবে: ইন্টারনেট ও অন্যান্য ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় সম্পাদন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল কমার্স হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই নীতিমালার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এতে বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ দেশে ডিজিটাল কমার্স খাতে ব্যবসা করতে হলে সব বিদেশি কোম্পানিকে দেশীয় অংশীদার নিতে হবে। কোনো বিদেশি কোম্পানির অংশীদারত্ব ৪৯ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এটা স্পষ্টতই করা হয়েছে ডিজিটাল কমার্স খাতে দেশীয় কোম্পানির প্রাধান্য নিশ্চিত করতে। এই বিধানের খুবই প্রয়োজন ছিল। এর ফলে ডিজিটাল কমার্স খাতে দেশি উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা ও বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া আলিবাবা, আমাজন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক ডিজিটাল ব্যবসায়ী কোম্পানির একচেটিয়া প্রাধান্যের সুযোগ থাকলে দেশি কোম্পানিগুলোর বিকাশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেটভিত্তিক বৃহৎ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া মুনাফা অর্জন ঠেকানো এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে নানা রকমের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি দেশেরই অভ্যন্তরীণ খাতের বিকাশ সাধনের অগ্রাধিকার থাকে, তাই বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় কোনো দেশেই নিঃশর্ত ও অবাধ নয়। পার্শ্ববর্তী ভারতে ডিজিটাল বাণিজ্য খাতের দ্রুত বিকাশ সাধিত হচ্ছে দেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর অংশীদারত্বের মাধ্যমে।

একটি উপযুক্ত নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, এখন প্রয়োজন এর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।