কয়েকটি কৌতুক ও একটি কবিতা

কৌতুকসাম্রাজ্যে চিরস্থায়ী আসন অধিকার করে রেখেছেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। প্রথমেই একটা বুশ কৌতুক বলে নিই। বুশ গেছেন একটা স্কুল পরিদর্শনে। তখন একটা বাচ্চা ছেলে উঠে দাঁড়াল। তার নাম স্ট্যানলি। সে বলল, ‘আমার তিনটা প্রশ্ন আছে। বলব?’ 

‘বলো।’ বুশ বললেন।
স্ট্যানলি বলল, ‘এক. আপনি কম ভোট পেয়েও কীভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় মেয়াদে হতে পারলেন? দুই. সাদ্দামের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও কেন ইরাকের ওপরে হামলা করা হলো? তিন. ক্লাস্টার বোমা প্রায়ই কেন ভুল করে হাসপাতাল আর স্কুলগুলোর ওপরে ফেলা হয়?’
তখন ঘণ্টি বেজে উঠল। বিশ মিনিটের বিরতি।
বিরতির পর আবারও প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলো। এবার হাত তুলল জন নামের একটা শিশু। সে বলল, ‘আমার পাঁচটা প্রশ্ন আছে।’
‘বলো।’
জন বলল, ‘এক. আপনি কম ভোট পেয়েও কীভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় মেয়াদে হতে পারলেন? দুই. ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও কেন ইরাকের ওপরে হামলা করা হলো? তিন. ক্লাস্টার বোমা প্রায়ই কেন ভুল করে হাসপাতাল আর স্কুলগুলোর ওপরে ফেলা হয়? চার. প্রশ্নোত্তর পর্বের সময় ঘণ্টাটা কেন কুড়ি মিনিট আগে বেজে উঠেছিল? পাঁচ. আমার বন্ধু স্ট্যানলি এখন কোথায়?’
এবার একটা উজবেক কৌতুক।
এক লোক বিয়ে করে বউ নিয়ে ফিরছে। দুজনেই একটা ঘোড়ার পিঠে চড়েছে। ফেরার পথে ঘোড়াটা একটা হোঁচট খেল। লোকটা গুনল: ‘এক’।
আবার ঘোড়া চলছে। পাহাড়ি পাথুরে পথ। ঘোড়াটা আরেকবার হোঁচট খেল। লোকটা বলল, ‘দুই’।
ঘোড়াটা আবারও চলছে। আরেকবার ঘোড়াটা হোঁচট খেল। লোকটা তখন ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল। তার বউকেও নামাল। তারপর তার বন্দুকটা বের করে সোজা গুলি করে দিল ঘোড়াটাকে। ঘোড়াটা মরে গেল।
তার নতুন বউ বলল, ‘এইভাবে সামান্য অপরাধে ঘোড়াটাকে মারা কি ঠিক হলো?’
লোকটা গুনল, ‘এক...।’
হাত শব্দটা বাংলা ভাষার এক অনবদ্য শব্দ। এটা দিয়ে যে কত কিছু প্রকাশ করা যায়। হাত করা, হাতটান, হাত তোলা, হাত ভালো, বাম হাতের কারবার, ডান হাতের কাজ, হাত দেওয়া, হস্তক্ষেপ করা, হাত লাগানো, অজুহাত থেকে শুরু করে হাতাহাতি। আমরা রাস্তায় স্লোগান দিই, ‘অমুকের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’ বা অমুকের হাতকে শক্তিশালী করুন। এই হাত থেকেই হাতি শব্দটার উৎপত্তি। মনে করা হতো, হাতির শুঁড়টা আসলে তার হাত। সেখান থেকে হস্তী বা হাতি। তেমনি হাতিয়ার কথাটাও এসেছে হাত থেকেই। হাতুড়ে কথাটাও। হাতড়ে হাতড়ে চিকিৎসা দিতেন হাতুড়ে চিকিৎসকেরা। আমাদের ক্রিকেট দলের অবস্থা তো ত্রাহি ত্রাহি। কোচ হাথুরুসিংহের অনুপস্থিতি আমরা খুব অনুভব করছি। হাতুড়ি কথাটাও হাত থেকেই এসেছে।
আইনস্টাইন বলেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী দিয়ে হবে, আমরা জানি না। চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে বাঁশের লাঠি দিয়ে।’
তারপর দুই দল মানুষ, যারা গুহায় থাকে, বনের ফল পেড়ে খায়, গাছের বাকল পরে, তারা একদিন মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করে ফেলল একটা হাতুড়ি।
এটা দিয়ে কী করে?
এটা কী?
এটার একটা হাতল আছে, হাতলের মাথায় এটা আবার কী? তারা ব্যাপক চিন্তাভাবনা করবে। এটার কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে তারা ভাববে এটা একটা বাদ্যযন্ত্র। এটা দিয়ে গাছের গায়ে আঘাত করলে দারুণ শব্দ হয়। তারা সেই হাতুড়ি দিয়ে বাঁশঝাড়ে যাবে, বাঁশে বাঁশে আঘাত করবে, সুর ফুটবে আর তারা নাচতে থাকবে-ও লে ও লে ওলাং...ও লে ও লে ওলাং।
তারপর তারা আবিষ্কার করবে, এটা কেবল বাঁশে মারলেই শব্দ হয় না। প্রতিবেশীর হাত-পায়ে মারলেও শব্দ হয়। শুধু শব্দ হয় না, গানও বেরোয়। তখন থেকে তারা সেটা দিয়ে পড়শির হাতে-পায়ে মারতে থাকবে।
কবি রফিক আজাদ খুব নরম হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘পাখি উড়ে গেলে তার নরম পালক কঠিন মাটিতে প’ড়ে থাকা ঠিক নয়। এই ভেবে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে।’
শক্ত মাটিতে নরম পালক পড়ে থাকা দেখেও যিনি কষ্ট পান, তিনিই তো কবি।
রফিক আজাদ আর নেই। কিন্তু তাঁর কবিতা আছে। তাঁর কবিতার বই আছে-হাতুড়ির নিচে জীবন। তিনি লিখেছেন:
ছোট-বড় নানা মাপের, নানা হাতের
হাতুড়িই নির্দিষ্ট আছে তোমার জন্যে
জন্ম-মুহূর্ত থেকে। হাতুড়ির বাড়ি-খাওয়া থেকে
নিষ্কৃতি নেই। এমনকি, তোমার পছন্দমতো
হাতুড়ির আঘাত
তুমি বেছে নিতে পারো না
তোমার জন্য বরাদ্দকৃত হাতুড়িটি অন্যেরাই বেছে নেবে
তুমি শুধু মাথা পেতে থাকার স্বাধীনতাটুকু
ভোগ করতে পারো,-হায় স্বাধীনতা।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক