ভয় সঙ্গে নিয়েই চলছে ভোটের প্রস্তুতি

রাজশাহী এখন পোস্টার-বিলবোর্ডের নগর
রাজশাহী এখন পোস্টার-বিলবোর্ডের নগর

সিলেটের মতো রাজশাহীতেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থীর সমর্থনে জামায়াত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও কাউন্সিলর পদে তারা কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৬ টিতে দলটির ১৬ জন নেতা প্রার্থী হয়েছেন। ওই সব ওয়ার্ডে বিএনপিও আলাদা প্রার্থী দিয়েছে। কোনোটিতে একাধিক। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতের ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নিতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগেও ‘গৃহবিবাদ’ কম নয়। বেশির ভাগ ওয়ার্ডে তাদেরও একাধিক প্রার্থী আছেন।

রাজশাহী এখন পোস্টার-বিলবোর্ডের শহর। তবে এগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর নয়। কাউন্সিলর প্রার্থী ছাড়া শহরের প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে যাঁর ৯৫ শতাংশ পোস্টার শোভা পাচ্ছে, তিনি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। নির্বাচনী প্রচার শুরুর দিনেই প্রায় সব সড়কে নৌকা প্রতীকের পোস্টার টাঙানো হয়। ফলে অন্যদের পোস্টার টাঙানোর জায়গা পাওয়া কঠিন। বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ প্রার্থী একাই শহরের সব জায়গা দখল করে নিয়েছেন। তারপরও ফাঁকে ফোকরে কোথাও বিএনপি কর্মীরা ধানের শীষের পোস্টার লাগাতে গেলে আওয়ামী লীগ বাধা দিয়েছে। তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এতেই প্রমাণিত হয় ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নেই। নির্বাচনী মাঠ শতভাগ অসমতল।

নির্বাচন কমিশন বেঁধে দিয়েছে পোস্টারের আকার ৪৫ সেন্টিমিটার বাই ৬৫ সেন্টিমিটার হতে হবে; নির্বাচনী কাজে কোনো বিলবোর্ড ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু রাজশাহীতে কোনো প্রার্থী এসব বিধিনিষেধ মানছেন না। রাস্তার মোড়ে, চৌরাস্তায় যেখানেই যিনি সুযোগ পেয়েছেন বিলবোর্ড লাগিয়েছেন।

কয়েক দিন আগে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদত হোসেন চৌধুরী রাজশাহী এসেছিলেন। তিনি প্রার্থী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বলেছেন, রাজশাহীর একটি কেন্দ্রেও অনিয়ম হতে দেওয়া হবে না। কিন্তু তাঁর এই আপ্তবাক্য প্রার্থী ও ভোটারদের আশ্বস্ত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ে অনেক অভিযোগ পেশ করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সব প্রার্থীই কমবেশি কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন। বিএনপির প্রার্থী যদি ৫টি অভিযোগ আনেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনেছেন ছয়টি। শেষ পর্যন্ত কোনোটিরই সুরাহা হয়নি। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেছেন, অভিযোগগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত করে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। কবে নেবেন? নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক দিন।

রাজশাহীর বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, দৃশ্যত রাজশাহীর ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু আছে। বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে জনসংযোগকালে দুর্বৃত্তদের ককটেল নিক্ষেপ ছাড়া আর কোনো অঘটন ঘটেনি। তারপরও মানুষের মধ্যে একধরনের শঙ্কা ও ভয় কাজ করছে। শঙ্কার কারণ কী? তাঁরা বললেন, নির্বাচনী প্রচারে সব দলের সমান সুযোগ না থাকা। সবচেয়ে বেশি ভয় ভোটের আগের ও ভোটের দিনের পরিবেশ নিয়ে। ভোটের দিন সব প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট কেন্দ্রে থাকতে পারবেন কি না? বললাম, সব প্রার্থী তো সব কেন্দ্রে এজেন্টই দিতে পারবেন না। তাঁদের জবাব, কেউ না পারলে সেই দায় তাঁর। কিন্তু যেই প্রার্থী সব কেন্দ্রে নির্বাচনী এজেন্ট দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কমিশনকেই নিতে হবে। খুলনা ও গাজীপুরে যেমনটি হয়েছে, সে রকম রাজশাহীতে যেন ভোটের আগে এজেন্টদের তাড়া করা না হয়। বিএনপি এখনই তাদের এজেন্টদের নাম ঘোষণা করছে না। তাদের ভয়, নাম ঘোষণা করলেই পুলিশ তাঁদের পাকড়াও করবে।

বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, শুরু থেকেই তারা নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করতে নানা রকম অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিএনপি আসলে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর পাঁয়তারা করছে। বিএনপি নেতারা এর জবাবে বলেছেন, ‘আমরা মাঠ থেকে সরে দাঁড়াব কী। তাঁরা তো আমাদের দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। তফসিল ঘোষণার পরও পুলিশ বিএনপির কর্মীদের নামে সাতটি মামলা দিয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনও নিশ্চুপ।’

গতকাল প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকেও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ভোটকেন্দ্র ও ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দিলেন। রাজশাহীর নির্বাচনী ঐতিহ্যের কথা রাজনীতিকদের স্মরণ করিয়ে দিলেন।

সব শহরে নারীর চেয়ে পুরুষ ভোটার বেশি। কারণ, অনেকের পরিবার-পরিজন গ্রাম থাকেন। কিন্তু রাজশাহীতে ব্যতিক্রম। ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ ভোটারের মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ জন। সে ক্ষেত্রে রাজশাহীর ফলাফল নির্ধারণে নারী ভোটারের ভূমিকাই বেশি থাকবে। তবে নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক না থাকলে তাঁরা ভোটকেন্দ্র যেতে চাইবেন না।

রাজশাহীতে এবারের সিটি নির্বাচনে নাগরিকদের পক্ষ থেকে যে সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে আসা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে গ্যাসসংকট, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা, অপরিচ্ছন্নতা, তরুণদের কর্মসংস্থানের অভাব, মাদকের বিস্তার, নগরীতে উন্নত মানের মিলনায়তন না থাকা, যোগাযোগ ও শিল্পের অপ্রতুল অবকাঠামো। তবে এও সত্য যে সব সমস্যার সমাধান সিটি করপোরেশনের হাতে নেই। তারা যে কাজটি করতে পারে তা হলো সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করা। তাতে জনগণের ভোগান্তি যেমন কমবে, তেমনি সরকারি অর্থের অপচয়ও বন্ধ হবে।

সিলেটে গিয়ে মনে হয়েছিল, সেখানে প্রচার চলছে নীরবে। প্রার্থীরা জনসংযোগকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু রাজশাহীতে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা সরব প্রচারে আগ্রহী। আচরণবিধি অনুযায়ী, বেলা দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মাইকিং করার অনুমতি থাকলেও অনেক রাত পর্যন্ত মাইকিং করতে দেখা গেছে। অনেকে গানে ও ছন্দে প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন।

রাজশাহীতে ১৩৮টি কেন্দ্রে ১ হাজার ২৬টি বুথ আছে। আইন অনুযায়ী, প্রতিটি বুথে প্রত্যেক প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট থাকার কথা, যিনি ভোটারদের পরিচয় নিশ্চিত করবেন। স্থানীয় একটি পত্রিকা খবর দিয়েছে, ‘নির্বাচনী এজেন্ট পাচ্ছে না বিএনপি’। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিএনপির নির্বাচনী এজেন্ট দেওয়ার মতো কর্মীর অভাব তাদের নেই। নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু থাকলে ও গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় না থাকলে শুধু কেন্দ্র নয়, প্রতিটি বুথে একজন করে নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারবেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, নাশকতার নতুন মামলা দিয়ে তাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৪ জুলাই প্রথম আলো শিরোনাম করেছিল, ‘রাজশাহীতে খুলনার বাতাস’। তবে রাজশাহীবাসী খুলনা বা গাজীপুর মডেলে নির্বাচন চান না। তাঁরা চান রাজশাহীতে আগের দুটি সিটি নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচনটিও সেভাবে হবে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচজন প্রার্থীই আধুনিক শহর, পরিবেশ ও নাগরিকবান্ধব শহর, সবুজ ও পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্বাচনের পর একসঙ্গে কাজ করার ওয়াদা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রতিশ্রুতি কতটা আলোর মুখ দেখবে, সেটি বলা কঠিন। নির্বাচনের আগে তাঁরা জনসেবক থাকলেও নির্বাচনের পর দলের ও গোষ্ঠী বিশেষের সেবক হয়ে যান।

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে একজন নারী নেত্রী কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘ভোটের আগে আপনারা যেভাবে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যান, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দেখান, ভোটের পর আর সেটি মনে রাখেন না। ভোটের পরও ভোটারদের কথা মনে রাখলে নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে কাউকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না। ভোটাররাই নিজদের স্বার্থে যোগ্য প্রার্থীকে খুঁজে নেবেন।’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail. com