বৃষ্টি চাই, তবে বর্ষা নয়

ঢাকার বর্ষা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? ছবি: প্রথম আলো
ঢাকার বর্ষা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? ছবি: প্রথম আলো

মফস্বল শহরে যে বাড়িতে থাকতাম, পাশেই ছিল স্কুলের মাঠ। সেখানে রোজ বিকেলে ফুটবল খেলতাম। শ্রাবণের ঘোর বর্ষায় দু-তিন দিন খেলা বন্ধ থাকত। এরপর মনটা আর বাধ মানত না। বন্ধুরা সবাই মিলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফুটবলে মেতে উঠতাম। মাঠের এখানে-সেখানে পানিতে আটকে যেত বল। সে আরেক মজা! ঘাসভরা পিছল মাঠে পা হড়কে পড়ে সড়াৎ করে চলে যেতাম অনেকটা। ব্যথা লাগত না। লাগলেও কেয়ার করতাম না। হি-হি হাসিতে চাপা পড়ে যেত।

শ্রাবণের বৃষ্টি নিয়ে কবি ফররুখ আহমদের দারুণ একটা কবিতা আছে। ‘বৃষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে/ রিমঝিমিয়ে রিমঝিমিয়ে/ টিনের চালে গাছের ডালে/ বৃষ্টি ঝরে হাওয়ার তালে...’। বাদলা দিনের একটানা সুরের যে জীবন্ত বর্ণনা কবিতায় মূর্ত, তা বৃষ্টির কোমলকান্তি অনন্য রূপটিকে চোখের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু ঢাকার ঢাকনা আঁটা জীবনে সেই বৃষ্টিকে খুঁজে পাওয়া দায়।

শুধু ঢাকা কেন, বন্দর নগর চট্টগ্রামও বৃষ্টির পানিতে দেখা দেওয়া জলাবদ্ধতায় অসহায়। ভরা বর্ষায় বৃষ্টিতে নাকাল—এমন নগর আর শহর আছে দেশজুড়েই। অথচ শৈশবে বর্ষার বাদল দেখেছি অন্য রকম।

বর্ষার বৃষ্টিভেজা মাঠে মাঝেমধ্যে পাওয়া যেত অন্য রকম মজা। স্কুলের পেছনে পুকুর-ডোবা ছিল কয়েকটা। অবিরাম বর্ষণে ডুবুডুবু হয়ে যেত সেগুলো। আর তখন নতুন পানির কই মাছ কানকোয় কাতরাতে কাতরাতে চলে আসত মাঠে। এবার খেলা ফেলে কই মাছ কুড়াও। সে দারুণ এক রোমাঞ্চ!

এভাবে সারাটা বিকেল আনন্দে মেতে বাসায় ফিরে যখন মায়ের একগাদা বকুনি খেতাম, তা হজম করার মধ্যেও ছিল আনন্দ। গায়ের কাদাজল ধুয়ে ঝরঝরে শরীরে যখন পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ আর সরষের তেলযোগে মুচমুচে মুড়ি সাবাড় করতাম, সে যে কী মজা, তা তো আর লিখে বোঝানো যাবে না।

বৃষ্টির দিন আরও মজা ছিল। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে স্কুলে গিয়ে দেখতাম, মোটে দশ-বারোজন এসেছে। ক্লাসে স্যার আসতেন আলসেমি নিয়ে। চলত গল্পগুজব। দেখা যেত, চারটা ক্লাস পরই ছুটি। তারপর আর কী? বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বইখাতা ভিজিয়ে বাড়ি ফেরা। আবার বকুনি। হ্যাঁচ্চো-হ্যাঁচ্চো। চুলার ধারে বইখাতা শুকাও। আর গা যদি একটু গরম হতো, তবে তো আরও মজা। মায়ের সোহাগমাখা সেবার সঙ্গে বোনাস হিসেবে জুটত দু-তিন দিন স্কুলে না যাওয়ার মওকা।

ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো মহানগরে বৃষ্টির সে মজা নেই। বৃষ্টি নিয়ে নগরবাসী থাকে অদ্ভুত দোলাচলে। দাবদাহে যখন প্রাণ তিষ্টানো দায়, তখন মন বলে—আয় বৃষ্টি ঝেঁপে। এই বৃষ্টিটাই যখন ঝিরিঝিরি ধারায় শ্রাবণের গান গায়, তখন তা হয়ে যায় অনাহূত। হবেই–বা না কেন? একটু জোর বৃষ্টিতেই জটিল জলজট। জলাবদ্ধতায় থমকে যায় নগরজীবন। ২৩ জুলাই টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগর প্রায় পুরোটাই ছিল পানিতে ভরা। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর প্রধান সড়কগুলোর কোথাও হাঁটু, কোথাও বা কোমরপানি। সে পানির যে কী তোড়, খরস্রোতা নদীকেও যেন হার মানায়।

মঙ্গলবারের টানা বৃষ্টিতে ঢাকার অবস্থাও ছিল বড্ড বেহাল। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে মিরপুর রোড দিব্যি বেগবান নদী হয়ে যায়। যানবাহনের চালক আর পথচারীরা পড়েন বেকায়দায়। কাজীপাড়ায় তো জলাবদ্ধ সড়কে রীতিমতো নৌকা চলেছে। মতিঝিল আর দিলকুশা ছিল পানির নিচে। ঢাকার এই ‘রূপ’ অবশ্য এখন আর নতুন কিছু নয়। প্রতি বর্ষায়ই হয়। নর্দমার নালিতে জট লেগে থাকা আর পানিনিষ্কাশনে সাবলীল ব্যবস্থার অভাবই এ জলজটের মূল কারণ। সংস্কার যে হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু এর মধ্যেও গলদ রয়েছে। তেজগাঁও এলাকার তেজকুনিপাড়ার ভেতর দিয়ে ফার্মগেটে যাতায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বছরের পর বছর ধরে বর্ষাকালীন বিড়ম্বনা হয়ে ছিল। একটু জোর বৃষ্টিতেই এ রাস্তার একটা অংশে অনেক পানি জমে যেত। মাঝেমধ্যে এমন পানি হতো, তা রিকশার সিট ছুঁই ছুঁই করত। সম্প্রতি এই রাস্তা ওই অংশবিশেষ ভেঙেচুরে মেরামত করা হয়েছে। রাস্তার সঙ্গে যুক্ত নর্দমা-নালাও ঠিক করা হয়েছে। এখন বৃষ্টিতে ওই রাস্তায় পানি জমে না বটে, তবে পানি জমে আরেক জায়গায়। সে নতুন বিড়ম্বনা।

টানা বৃষ্টি হলে এমন দুর্গতির দেখা মেলে ঢাকার অনেক এলাকাতেই। মতিঝিল ও দিলকুশার মতো কর্মব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকায় যখন পানি জমে, পথচারী আর যানবাহনের যাত্রীদের জন্য তা যে কতটা দুর্ভোগ বয়ে আনে, তা বলে বোঝানোর মতো নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের ডাকে দুর্যোগের রাতে উত্তাল ঢেউয়ে মাতাল দামোদর নদী সাঁতরে বাড়ি ফিরেছিলেন। বৃষ্টির জলে মতিঝিলের সড়ক যখন নদী বনে যায়, ওই এলাকার চাকরিজীবী মানুষের সামনে তখন দামোদরই যেন বয়ে যায়। জলের ভেতর ওত পেতে থাকা গর্তে পড়ে মরো, আর হোঁচট খেয়ে নোংরা জলে হাবুডুবু খাও—চাকরি বাঁচাতে সময়মতো অফিসে পৌঁছাতেই হবে।

আর যাত্রায়ও কি কম বিড়ম্বনা! স্কুটারের ভাড়া এক লাফে গিয়ে পৌঁছায় টংঘরে। ১৫০ টাকার জায়গায় চালক ২৫০-৩০০ টাকা হাঁকে। উবার উবার করে এত দিন মুখে ফেনা তুলেছি! এখন উবারের সার্ভিস নিতে অন্তত দুবার ভাবতে হয়। বৃষ্টির দিন চাহিদার ওজর দেখিয়ে ভাড়ার রেটটা তুলে দেয় তালগাছে। আর রিকশাচালক? হাঁটু মুড়ে রিকশার সিটে কুঁজো হয়ে এমন করে বসে থাকেন, অনুনয়-বিনয় কানেই তোলেন না।

বাজারে যাবেন? সেখানেও বিক্রেতারা বৃষ্টির গান শোনাবে। দেখাবে সরবরাহে ঘাটতি। বর্ষার হিমেল হাওয়ার মধ্যেই গায়ে ফোসকা পড়বে সবজির দাম শুনে। মাছ-মাংসে পাবেন আগুনের আঁচ। ডিমের ডজন ৭৫ টাকা থেকে হাঁটি হাঁটি করে এর মধ্যে সেঞ্চুরি করেছে। এখানেও বৃষ্টির বদনাম। বলে, বর্ষায় খামারে উৎপাদন কম। বৃষ্টির গানে মজে মজা করে ডিম-খিচুড়ি খাওয়ার জো নেই।

আসলে এত বলে তো লাভ নেই। প্রতিবছর বর্ষা আসে, শ্রাবণের অঝোর ধারায় নগর ভাসে। শেষ হয় না জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ। এই দুর্ভোগ কীভাবে কাটবে, সে সমাধান তো নগরবাসীর কাছে নেই। আছে কর্তৃপক্ষের হাতে। তারা এ সমাধান কীভাবে করবেন, এটা তাঁরাই বুঝবেন। আমরা বরং এই মিনতি করি—ও বৃষ্টি তুমি এই নগরে বর্ষা হয়ে এসো না। থেমে থেমে এসো। নিদাঘ দুপুরে কেবল প্রাণ জুড়িয়ে যেয়ো।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
[email protected]