ধরি বাস, না ছুঁই পানি

বাংলা রম্য-রসিকতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের একটা সাইট আছে—‘eআরকি’। তারা একটা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেছে—ধরি বাস, না ছুঁই পানি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটা বাস পানির নিচে অর্ধেকটা ডোবা। দরজাও প্রায় আধেকটাই ডুবে গেছে। কতগুলো স্কুলবালক সেই বাসের হাত ধরে ঝুলে আছে। পানি থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টারত। তাদের মুখে হাসি। আর জানালা দিয়ে তার বন্ধুরা তাদের কসরত দেখছে, তাদেরও মুখ হাসি হাসি। ধরি বাস, না ছুঁই পানি।

আমরা যারা পত্রিকায় লেখালেখি করি, আমাদের অনেকেরই অবস্থা ‘ধরি বাস, না ছুঁই পানি’ হয়ে গেছে। কাজেই এই ছবি দেখে যখন হাসি, সেটা মোনালিসার হাসি, এই হাসির পেছনে গোপন বিষাদ আছে। সে প্রসঙ্গ থাক। স্কুলবালকদের কথায় আসি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কবে ‘বিলাসী’ গল্পে লিখেছিলেন, ‘যে ছেলেদের সকাল আটটার মধ্যে বাহির হইয়া যাতায়াতে চার ক্রোশ পথ ভাঙ্গিতে হয়-চার ক্রোশ মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশি-বর্ষার দিনে মাথার উপর মেঘের জল ও পায়ের নীচে এক হাঁটু কাদা এবং গ্রীষ্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধুলার সাগর সাঁতার দিয়া স্কুল-ঘর করিতে হয়, সে দুর্ভাগা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি মুখ লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না।’

আমাদের এই স্কুলছাত্রদেরও সরস্বতী বর দেবেন, নাকি এদের দুঃখ-কষ্ট দেখে মুখ লুকাবেন, আমার জানা নেই। কিন্তু এদের মুখের হাসি যে যায় না! কার যেন লেখায় পড়েছিলাম, কলকাতায় কেউ পিছলে পড়ে গেলে আর্তনাদ করে ওঠে, ও বাবা গো, ও মা গো, পড়ে গেলুম রে, মরে গেলুম রে, কে কোথায় আছিস, আমাকে ধর। আর ঢাকাইয়া কেউ পিছল খেয়ে পড়লে বলে, ওরে আমারে তোল, দেখিস না, মাটি ব্যথা পাইতাছে। বাংলাদেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট সইতে জানে, লড়াই করতে জানে, কিন্তু তাদের মুখের হাসিটা অপরাজেয়। সুন্দর একটা দেশ আমরা পেয়েছি, আর পেয়েছি সুন্দর একদল মানুষ। কিন্তু দেশটাকে সুন্দর করার কাজটা আমরা করতে পারছি কই?

বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে—এটা তো সবাই জানে। কিন্তু বৃষ্টি হলেই কেন ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ডুবে যাবে, চট্টগ্রাম থইথই করতে থাকবে। একবার রস+আলোর জন্য প্যারোডি ছড়া লিখে দিয়েছিলাম:
আমাদের রাজপথ চলে আঁকে বাঁকে
বৃষ্টির দিনে তায় গলাজল থাকে
পার হয়ে যায় গরু থেমে যায় গাড়ি
মাঝে মাঝে শোনা যায় মেয়রের ঝাড়ি।

হায়, আমাদের প্রিয় মেয়র আনিসুল হক নেই, এখন মেয়রের ঝাড়িও শোনা যায় না। আর মেয়রকে দোষারোপ করে লাভও নেই। ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণের কাজটা অধিক সন্ন্যাসীর। অন্তত সাতটা প্রতিষ্ঠান এক ঢাকার পানিনিষ্কাশন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিয়োজিত ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ।’ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজউক, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা জেলা প্রশাসন। ঠেলাঠেলির ঘর, খোদায় রক্ষা কর।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যার কি কোনোই সমাধান নেই। গত বছরও মন্ত্রী-মিনিস্টারের কণ্ঠে আশ্বাস শুনেছি, আগামী বছর আর ঢাকার রাস্তায় পানি জমবে না। সত্যবাদীর কথার নড়চড় নেই। দেয়ার ইজ অলওয়েজ এ নেক্সট ইয়ার। আগামী বছর আগামী বছরও আসবে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ফেইলিওর বা প্রকৌশলগত ব্যর্থতা দেখলে দাঁতের নিচে বালি পড়ার মতো অস্বস্তি লাগে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরের অকথ্য, অসহ্য জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান এত দিনেও করা গেল না, এটা কি হয়! আমরা জানি, রেকর্ড ভঙ্গকারী বৃষ্টি হলে একটা শহর অচল হয়ে যেতে পারে। তা মুম্বাইয়ে হয়, নিউইয়র্কেও হয়। কিন্তু ঢাকা তো আর আসমানীর ঘর নয় যে একটুখানি বৃষ্টি হলেই এখানে পানি গড়গড়ি খাবে। বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক সাংবাৎসরিক বৃষ্টিপাতে কেন শহর অচল হবে?

গত পরশু ২৫ জুলাই ছিল অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন। স্যার ৭৯ শেষ করে আশিতে প্রবেশ করলেন। স্যারের কাছে গিয়েছিলাম নিজের ব্যাটারিটা একটু রিচার্জ করে নেওয়ার জন্য। আজকাল বড্ড হতাশ লাগে। মনে হয়, কিছুই তো হলো না, সেই সব সেই সব...আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বললেন, মানুষ তো একটা নাছোড় জিনিস, সে হতাশা মেনে নেয় না, ধ্বংস মেনে নেয় না। তার নিজের ভেতরে এক প্রচণ্ড-শক্তি আছে, ধ্বংস প্রতিরোধ করার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও মনে হয়েছিল, আর কোনো আশা নেই।

আমিও আশা খুঁজছি। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলে আঁকড়ে ধরে। এই মুহূর্তে দুটো আশার ভেলা আমি আঁকড়ে ধরছি। গত ঈদের আগে সরকারের সার্বিক উদ্যোগ এবং বিশেষ তৎপরতায় মানুষের ঘরমুখী যাত্রাটা অনেকটাই নির্বিঘ্ন হতে পেরেছিল। অন্তত আমাদের রাস্তাঘাটের যে চরম দুরবস্থা এবং ঈদের আগে একসঙ্গে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ চলাচল করে, তার সীমা-ছাড়ানো অঙ্কটা বিবেচনায় নিলে গত ঈদের সড়ক ব্যবস্থাপনাকে স্টার মার্কস দেওয়া যাবে। কিন্তু ও তো বিশেষ অবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থা। সারা দেশে রাস্তাঘাটগুলোর এই রকমের দুর্দশা কেন? উফফ। চলাচল করা তো দুঃসাধ্য, তাকানোই তো যায় না।

দ্বিতীয় যে আশার ইঙ্গিতটা পাচ্ছি তা প্রধানমন্ত্রীর কথায়। প্রথম আলোর খবর, ডিসি সম্মেলনে উদ্বোধনী দিনে প্রধানমন্ত্রী বিনা দ্বিধায় টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি, সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূল করতে ডিসিদের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, কে কোন দল করে, কী করে, সেগুলো দেখার দরকার নেই। যদি কেউ বাধা দেয়, তাহলে তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) সঙ্গে বা তাঁর কার্যালয়ে যোগাযোগ করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা যদি মান্য করা হয়, বাংলাদেশের অর্ধেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের রাস্তাঘাট যে ভাঙা, আমাদের শহরগুলোয় যে পানি জমে, সেসব সমস্যারও অনেক সমাধান নিহিত রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানের মধ্যে।

এই লেখা শুরু করেছিলাম স্কুলছাত্রদের হাসিমুখের প্রসঙ্গ দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষের একটা প্রশংসা দেশি-বিদেশি জ্ঞানী-গুণীরা করে থাকেন তা হলো, ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। রেজিলিয়েন্স। শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অভাব-সবকিছু ছাপিয়ে এখানে জয়ী হয় জীবন। আমাদের মানুষেরা অপরাজেয়।

মুখের এই হাসিটা কিন্তু মূল্যবান। এই হাসিই আমাদের বিজয়ী করবে। এই হাসিটা যেন কেড়ে নেওয়া না হয়। মানুষের মুখের হাসি যেন অমলিন থাকে। মানুষকে যেন অপমান করা না হয়। পেটে ভাত না থাকলেও এ দেশের মানুষ মুখে হাসি আনতে পারে, কিন্তু তাকে যখন অপমান করা হয়, ব্যক্তি মানুষ এবং সম্মিলিত মানুষকে যখন দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, তখন বাংলাদেশ ভীষণ তেতে ওঠে। প্রথমে সেটা বোঝা যায় না। কিন্তু একদিন বারুদের মতো বাংলাদেশ বিস্ফোরিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন:
এ রকম বাংলাদেশ কখনো দেখো নি তুমি,
মুহূর্তে সবুজ ঘাস পুড়ে যায়,
ত্রাসের আগুন লেগে লাল হয়ে জ্বলে ওঠে চাঁদ,
নরম নদীর চর হা করা কবর হয়ে গ্রাস করে পরম শত্রুকে...

বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ, বর্ষাকালে সেই পলিমাটি মায়ের স্পর্শের মতো নরম, কিন্তু চৈত্রে ইস্পাতের মতো কঠিন। এই পরিবর্তন প্রতিদিন ঘটে না। ঘটবে যে টেরও পাওয়া যায় না। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই ঘটে। ঘটে যদি মানুষকে মানুষের মর্যাদাবোধ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। প্রথম আলোর গতকালের শেষ পাতায় খবর আছে-শতাব্দীর দীর্ঘ চন্দ্রগ্রহণ আগামীকাল। ১০৩ মিনিট ধরে চন্দ্রগ্রহণ ঘটবে। পৃথিবীজুড়ে গণতন্ত্রের হালহকিকত নিয়ে নানান কথা উচ্চারিত হচ্ছে—প্রশ্ন উঠেছে, গণতন্ত্র কি ব্যর্থ হতে চলেছে? চন্দ্রগ্রহণ দীর্ঘ হলে তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা কাজ করবে। সূর্যগ্রহণ যেন দীর্ঘতম না হয়।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক