টাকা ওড়ানোর মহৎ উপায়

বাংলাদেশের ছোট ছোট শিশু-কিশোর বুঝিয়ে দিয়েছে—ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে কীভাবে সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশের ছোট ছোট শিশু-কিশোর বুঝিয়ে দিয়েছে—ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে কীভাবে সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ছবি: প্রথম আলো

টাকার পাখা আছে—রিচেজ হ্যাভ উইংস! আর ওড়াতে জানলে টাকা ওড়ে বটে! কীভাবে টাকা ওড়াতে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছে ভারতের মধ্যপ্রদেশের জবলপুরের এক কিশোর। দশম শ্রেণির ওই ছাত্রের বাবা একজন ব্যবসায়ী। বাড়ি বিক্রি করে ৬০ লাখ রুপি এনে রেখেছিলেন আলমারিতে। কোন ফাঁকে যেন ছেলেটি আবিষ্কার করে এই টাকা। আর অমনি তার মাথায় ‘ফটিক-বুদ্ধি’ গজায়!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ছুটি’র সেই ফটিকের কথা বলছি। গল্পের শুরুতেই রয়েছে—‘বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট্ করিয়া একটা নূতন ভাবোদয় হইল; নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে।’ তেমনই এই কিশোর ভাবল, বাবার টাকা দুহাতে ওড়াবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বাবা কিছু টের পাওয়ার আগেই ৪৬ লাখ রুপি উড়িয়ে দিল সে। তাই বলে ফানুস বা ঘুড়ির মতো ওড়ায়নি, ৩৫ জন বন্ধুর মধ্যে বিলি করে দিয়েছে। এ খবর এখন ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ঘুরছে। ছেলেটি মহা দানবীর। যে বন্ধুটি দিনমজুরের ছেলে, তাকে সে সবচেয়ে বেশি—১৫ লাখ রুপি দিয়েছে। পুলিশ এখন ছুটছে এই টাকা উদ্ধারে।

ওই ‘ছুটি’ গল্পেই বর্ণিত রয়েছে—‘বিশেষত, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।’ ভারতের ওই কিশোরের সঙ্গে এমন বৈশিষ্ট্য মেলে। দৃশ্যত, এখন সে তার বাবার কাছে স্রেফ ‘বালাই’ বৈ কিছু নয়।

ইসরায়েলি সেনাদের সামনে বিক্ষুব্ধ ১৭ বছরের ফিলিস্তিনি কিশোরী আহেদ তামিমি। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলি সেনাদের সামনে বিক্ষুব্ধ ১৭ বছরের ফিলিস্তিনি কিশোরী আহেদ তামিমি। ছবি: এএফপি

চঞ্চলমতি কিশোরেরা যুগ যুগ ধরেই এমন ‘অনাসৃষ্টি’ ঘটিয়ে আসছে। দুরন্ত কৈশোর চমক দেখানোর বয়স। এ বয়সে মানুষ নানা কিছু ঘটায়। এর মধ্যে কোনো ঘটনা নিভৃতে পড়ে থাকে, কোনোটি প্রকাশ হয়ে হইচই ফেলে দেয়। কিশোর-কাণ্ড কোনোটি সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে, কোনোটিবা ডেকে আনে বিপদ।

এই তো, কিছুদিন আগে থাইল্যান্ডের পাহাড়ি গুহায় অভিযান চালাতে গিয়ে পানিতে আটকা পড়ে দুনিয়াজুড়ে কী হইচইই না বাধিয়ে দিল ১২ কিশোর। কিশোর ফুটবলারদের এই আটকে পড়ার জন্য অবশ্য তাদের কোচকে অনেকটা দায়ী করা হয়। তিনি নিজেও দোষ স্বীকার করেন। কিন্তু ইচ্ছা না থাকলে তো আর ওই কিশোরেরা অভিযান চালাতে পারত না। তাদের উদ্ধারে নেমে একজন তো মারাই গেলেন। তবু রক্ষা যে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় উদ্ধার হয়েছে সবাই।

কিশোরমনে ভাবনার চেয়ে ভাবের প্রভাব বেশি। যুক্তির চেয়ে প্রাবল্য থাকে আবেগের। এ জন্য তারা চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ১৭ বছরের ফিলিস্তিন কিশোরী আহেদ তামিমি গাজা সীমান্তে দুই ইসরায়েলি সেনাকে চড়-চাপড়ে নাজেহাল করতে কসুর করেনি। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করার প্রতিবাদে গত ডিসেম্বরে পশ্চিম তীরে বিক্ষোভ করছিল ফিলিস্তিনি জনতা৷ এ সময় ফিলিস্তিনের সমাজকর্মী তামিমির পরিবারের এক সদস্যের মাথায় গুলি করে ইসরায়েলি সেনারা৷ এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে একপর্যায়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ইসরায়েলি সেনাকে চড় দেয় তামিমি৷ এ ঘটনা থেকে তামিমি ফিলিস্তিনি মানুষের কাছে বীরের আসনে রয়েছে। ইসরায়েলি কারাগারে আট মাসের কারাভোগের পর সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে সে। তামিমির সেই চপেটাঘাত বিশ্ববিবেকের কাছে ইসরায়েলি সেনাদের অন্যায়-অবিচারের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরে।

চঞ্চলমতি কিশোরেরা হুজুগে মেতে, পারিপার্শ্বিক ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে, দুঃসাহস দেখিয়ে ‘হিরো’ বনে যাওয়ার তাড়নায়ও অনেক কাণ্ড করে! আমাদের দেশে কিশোর ‘গ্যাং কালচার’ ও ‘বাইক-সন্ত্রাসের’ মতো ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসে। অপরিণত বয়সে তাদের বেপরোয়া চলাফেরা এবং অপরাধমূলক ঘটনা আমাদের যেমন ব্যথিত করে, তেমনি ফুটবলে অনূর্ধ্ব-১৫ বছরের মেয়েদের দুর্বার অগ্রযাত্রা, পাকিস্তানকে ১৪ গোলে হারানোর ঘটনা বুকভরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস এনে দেয়। মনে পড়ে, নব্বইয়ের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে বিকেএসপির গড়া একটি কিশোর ফুটবল দল ডেনমার্ক ও সুইডেনে গিয়ে খেলে দুটি টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতে কী বিপুল আলোড়নই না সৃষ্টি করেছিল! সেই কিশোর ফুটবলারদের ওপর ভর করে বাংলাদেশের মানুষ তখন ফুটবল বিশ্বের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখেছে—‘দেখিস আমরাও একদিন...!’ ১৯৭৯ সালে নিয়াজ মোরশেদ নামের এক কিশোর দেশের জাতীয় দাবায় ঝানু দাবাড়ুদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। পরে সেই বিস্ময় বালক দাবায় দেশের জন্য প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টারের সম্মানও নিয়ে এসেছে। এ দেশে দাবার স্বর্ণযুগ ছিল তখন। কিশোরেরা এভাবে হুট করে জেগে উঠে আলো জ্বেলে যায়, স্বপ্ন দেখায়, আমরা বড়রা তা অনেক ক্ষেত্রেই লালন করতে পারি না।

আহেদ তামিমি
আহেদ তামিমি

গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষার সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের নিচে চাপা পড়ে নিভে গেল ঢাকার রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুটি তাজা প্রাণ—দিয়া ও করিম। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনে নামল ছোট ছোট শিশু-কিশোর। রাস্তায় চলাচলকারী গাড়িওয়ালা বড়দের ভুলগুলো তারা ধরিয়ে দিতে লাগল। বুঝিয়ে দিল, ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে কীভাবে সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বড়দের ডাকে তারা কিন্তু সুশৃঙ্খলভাবেই ঘরে ফিরে গেছে। স্কুলে ফিরে পাঠে মন দিয়েছে। কিন্তু বড়রা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে এসে আবার সেই আগের মতোই হিমশিম খাচ্ছে। ছেলে-বুড়ো অনেকেই ট্রাফিক আইন মেনে চলেছে না।

সড়কে বিশৃঙ্খলা ফিরে আসায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে গত রোববার শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ-সংলগ্ন পথচারী আন্ডারপাস নির্মাণকাজের উদ্বোধনকালে ভাষণে তিনি বলেন, ‘যত দিন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ছিল, তারা ট্রাফিক কন্ট্রোল করছিল এবং সবাই তাদের কথা মেনে নিয়েছিল, এটা ঠিক। কিন্তু যখনই সবাই ফিরে গেল, স্বাভাবিক হলো যানবাহন চলাচল, তারপর কী দেখি? রাস্তার পাশেই ফুটওভার ব্রিজ, আমরা দেখলাম, ইয়ং ছেলেমেয়ে সামান্য কয়েক কদম হাঁটলে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারে, সেটা না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাত দেখিয়ে দেখিয়ে।’ (প্রথম আলো, প্রথম পাতা, ১৩ আগস্ট ২০১৮)।

বাবার টাকা অকাতরে দান করা সেই কিশোরের কথায় ফিরে আসি। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ‘বন্ধু দিবস’ জাঁকালোভাবে উদ্‌যাপনে বন্ধুদের এভাবে টাকাগুলো দিয়েছে সে। এখানে একটা কথা পরিষ্কার, এই টাকা বিলানোর মধ্যে তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই—উপহার দিয়ে বন্ধুদের খুশি করা। এখানে নিজের কোনো হীন স্বার্থ বা অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। এটা ঠিক যে এভাবে টাকা উড়িয়ে বাবার প্রভূত আর্থিক ক্ষতি করেছে সে, সবার কাছেই যা অনাকাঙ্ক্ষিত চরম আহাম্মকি কাজ। আইনের দৃষ্টিতে তা অপরাধও বটে। কারণ, টাকা তো আর কিশোরের নিজের নয়। কিন্তু বন্ধুদের প্রতি তার যে অকৃত্রিম অপরিসীম ভালোবাসা, এই ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘ভালোবাসাকে’ অবশ্যই সেলাম। কিশোরটি যা করেছে, এর মধ্যে শতেক দোষ থাকলেও তার সর্বজনীন হিতকর বোধটি মহৎ।

এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি কারও কাম্য নয় ঠিকই, কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন দু-একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে বলেই আমাদের মরচে ধরা মানবতা আর ভ্রাতৃত্ববোধ রেতের ঘষা খেয়ে চকচকে হয়। শুরুতে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কথা বলেছিলাম। কবিগুরুর একটি কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করি। কবি লিখেছেন—‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা/ ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ নবীন ও কাঁচারা ঘা মেরে আধমরা মানুষকে জাগিয়ে সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে দেবে—এই প্রত্যাশাই করি। 

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

[email protected]