ওরা কাঁদছে, ওদের মুক্তি দিন

প্রথম অালো ফাইল ছবি
প্রথম অালো ফাইল ছবি

ওরা ছিল ১০ জন। এখন আরও ২২ জন যুক্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওরা। ওরা আছে কারাগারে। ওরা কাঁদছে ব্যথায়, অপমানে। ওদের কোমরে দড়ি লাগিয়ে, হাতকড়া পরিয়ে যখন ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ওদের কেউ কেউ মুখ ঢাকছিল। আসল সত্যটা হলো, মুখ ঢাকছিলাম আমরাই। শিক্ষার্থীরা কেন মুখ ডাকবে? মুখ ঢাকার কথা আমাদের, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার। এত দিন আমরা বলতাম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোনো আন্দোলনে আসে না, তারা সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। সেই জায়গায় আমরা আজ আর নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে, তাদের ২২ জন এখন কারাগারে।

আজ যখন এই শিক্ষার্থীদের অশ্রুসিক্ত ছবি দেখছিলাম তখনো মনে হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের এই দৃশ্য শিক্ষক হিসেবে দেখা খুবই বেদনার। আমার চোখের সামনে ভাসছে ২০১৩ সালের আমাদের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী সুব্রত শুভর মুখ। ২০১৩ সালে তাকেও এমন করে রশি বেঁধে কম্পিউটার সামনে দিয়ে ছবি তুলে সব পত্রিকায় দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষক হিসেবে আমার নিজেকে তখন খুব ছোট মনে হয়েছিল। চোর, ডাকাত আর সন্ত্রাসীদের মতো সুব্রতসহ আরও চারজন ব্লগারের ছবি ঘুরছিল ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমে। ওরা অনেকেই আর দেশে থাকতে পারেনি।

প্রথম দফায় কোটা আন্দোলনে ১০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী আটক হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাজধানীর ভাটারা ও বাড্ডা থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় ২২ জন ছাত্রকে। এরা ইস্ট ওয়েস্ট, নর্থ সাউথ, সাউথইস্ট ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের রাখা হয়েছিল আদালতের হাজতখানায়। শিক্ষার্থীদের এই দুঃসময়ে এগিয়ে আসেন তাদের শিক্ষকেরা। দেনদরবার করেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তাঁদের শিক্ষার্থীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু একসময়ের প্রতিবাদী শিক্ষার্থী বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী তাদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে অনড়। আজকে এই তরুণ শিক্ষার্থীদের যেই বয়স সেই বয়সে, ৫০ বছর আগে শিক্ষামন্ত্রীও রাজপথেই ছিলেন।

মাননীয় মন্ত্রী আপনি জানেন, আমরাও জানি ওরা চোর নয়, ডাকাত নয়—ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ওরা সবাই আন্দোলনে লড়ছিল। সেই আন্দোলন নিয়ে সরকার-আন্দোলনকারীদের ভিন্ন রকম বোঝাপড়া থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার কোনো সমাধান নয়। গ্রেপ্তার হওয়া সবাই শিক্ষার্থী হলেও ওদের মামলার এজাহারে সেটা উল্লেখ করা হয়নি। তা ছাড়া, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। আপনারাই তো বলেছেন জ্বালাও-পোড়াও শিক্ষার্থীদের কাজ নয়, এটা করছে তৃতীয় পক্ষ। তাহলে তাদের খুঁজে বের করুন—সেই সব তৃতীয় পক্ষকে? কেন শিক্ষার্থীদের কারাগারে রাখছেন?

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এই শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কঠোর অবস্থান কিছুতেই বাহবা দিতে পারছি না। পারছি না কারণ, আমার মাথায় বারবার আঘাত করছে দিনমজুরের ছেলে আবু বকরের ঘটনাটি। ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের কর্মীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে খুন হন ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম দুই বর্ষে প্রথম হওয়া অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র আবু বকর। খুনের পর প্রকাশিত পরীক্ষার ফলেও দেখা যায় আবু বকর প্রথম হয়েছে। কিন্তু তখন এই পৃথিবীতে আর নেই সে। আট বছর পরে দেওয়া মামলার রায়ে এই খুনের দায়ে কারও শাস্তি হয়নি। সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছে। পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছিল, আবু বকরকে কেউ খুন করেনি। অর্থাৎ ছাত্রলীগের সংঘাতে কর্মী বা সাধারণ ছাত্র খুন হয়। মামলা হয়। কিন্তু বিচার হয় না, বিচার হলেও খুনি বেকসুর খালাস পায়। মাননীয় মন্ত্রী সেই অপরাধগুলোর সময় আপনি কেন বলতে পারেন না, ওদের মাফ করা যাবে না, কারণ ওরা হত্যাকারী, ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করছে। তাহলে আইন কি শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য?

আমরা শিক্ষক। আমরা সব সময়ই শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আটককৃত সেই শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেয়নি। এই বিবেচনায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এক ধাপ এগিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন। সেই উপাচার্যদের মতোই আমার অবস্থান। আমরা কখনো শিক্ষার্থীদের সঙ্গী হই, কখনো বকা দিই, কখনো তাদের ভুল শুধরে দিই—আবার কখনো আমরা তাদের সঙ্গে চলতে গিয়ে নিজেদের ভুলও শুধরে নিই। আমরা তাদের ১৮ বছর বয়স থেকে দেখি। চার-পাঁচ বছর এই শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে থাকে। এই সম্পর্কটি কখনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো যাবে না। তাই তো যখন ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতারা তাদের মারধর করে কিংবা নির্যাতন করে, তখন তারা সেই নেতা বা নেতাদের কাছে হাতজোড় করে না, ক্ষমতা চায় না বরং জাপটে ধরে আশপাশে থাকা শিক্ষকদের। কারণ, তারা বিশ্বাস করে একজন শিক্ষক যে দলই করুক না কেন, শিক্ষার্থীকে তাঁরা রক্ষা করবেন, পুলিশের হাত থেকেও তাঁরা তাঁদের সন্তানটিকে ছাড়িয়ে নেবেন। এটাই হয়তো শিক্ষকতার অলিখিত দায়িত্ব।

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আমরা পারিনি তা করতে। আমাদের ব্যর্থতা অনেক। সেই দায় এবং দায়িত্ব থেকেই সরকারকে অনুরোধ করে বলছি, ওদের ছেড়ে দিন। ওরা শিক্ষার্থী। ওদের ক্লাসে ফিরে আসতে দিন। ওরা কাঁদছে, কাঁদাচ্ছে আমাদের। আমরা কোনো অবস্থাতেই চাই না আমাদের শিক্ষার্থীরা আটক থাকুক। দেখা এবং অদেখা সহপাঠীরা যখন কারাগারে তখন অন্য শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসবে কেমন করে? স্পষ্ট করে জানাতে চাই আমার ছাত্র হোক বা অন্য কারও, শিক্ষার্থীরা কারাগারে কাঁদছে, এই ছবিটি যখন পত্রিকায় দেখি, হৃদয়টা ভেঙে যায়—এই ভেবে যে ওরা আমাদের জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চায়, অথচ আমরা ওদের বাঁচাতে পারি না, কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারি না, ওদের নিরাপত্তা দিতে পারি না। শুধু অশ্রু দেখি, নিপীড়িত শরীর দেখি, কখনো লাশ দেখি। শিক্ষক হিসেবে এর চেয়ে যন্ত্রণার আর কী হতে পারে?

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক