সালেহা বেগমের সংগ্রাম ও ঈদের আনন্দ

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

সালেহা বেগম কথা রেখেছেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর ছেলেকে না নিয়ে তিনি বাড়ি যাবেন না। তিনি ছেলেকে নিয়েই বাড়ি গিয়েছেন। এক মাস ধরে ডিবি অফিসে, আদালত চত্বরে, রাজপথের মানববন্ধনে তিনি তাঁর দাবির কথা জানিয়েছেন।

সালেহা বেগমের ছেলে রাশেদ খান কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে মাসখানেক আগে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তির আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়া হয়। কারাগারে পাঠানোর আগে পুলিশ দুই দফায় তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

এ খবর শুনে ঝিনাইদহের সালেহা বেগম ঢাকা ছুটে এসেছিলেন। তিনি অন্যের বাসায় কাজ করে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। রাশেদের বাবাও দিনমজুর।

দরিদ্র পরিবারের বড় ছেলে ছাত্রদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে কারাগারে—এই খবরে মায়ের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সালেহা বেগম ঢাকা এসে একবার ডিবি অফিসে, একবার আদালত প্রাঙ্গণে ধরনা দিতে থাকেন। তিনি একবার অভিমান ও ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘আমার ছেলেকে মুক্তি দিন। আমি আর ঢাকায় থাকব না। ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব।’

কেন একজন মাকে এই আহাজারি করতে হবে?

গতকাল সোমবার আদালত যখন রাশেদের জামিনের ঘোষণা দেন, সালেহা বেগম আদালত প্রাঙ্গণেই অপেক্ষা করছিলেন। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ‘সালেহা বেগম তাঁর ছেলের বউ রাবেয়া খাতুনকে জড়িয়ে ধরে নির্বাক রইলেন। তখন দুজনের চোখ দিয়ে লোনা জল গড়িয়ে পড়ছিল। সালেহা দুহাত ওপরে তুলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার বাবা জামিন পেয়েছে...। এবার বাবাকে নিয়েই বাড়ি ফিরব।’

ছেলের গ্রেপ্তারের খবর শুনে সালেহা বেগম ঢাকায় আসেন। সেই থেকে তিনি অচেনা-অজানা ঢাকা শহরে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। এক দিনের জন্যও বাড়ি যাননি। তিনি বলেছিলেন, ছেলেকে না নিয়ে বাড়ি যাবেন না। সালেহা বেগম কথা রেখেছেন। ছেলেকে নিয়েই বাড়ি গিয়েছেন। ছেলের মুক্তির জন্য আইনজীবীসহ যাঁরা সহায়তা করেছেন, তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সালেহা বেগম যেন শুধু রাশেদের মা নন, তিনি হয়ে উঠেছেন আন্দোলনকারী সবার মা। গতকাল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হওয়া আরও ১৮ জন ছাত্র জামিন পেয়েছেন। অন্যদিকে, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হওয়া আরও ১২ ছাত্রের জামিন দিয়েছেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। এর আগে গত রোববার ঢাকার আদালত থেকে জামিন পান আরও ৩২ জন ছাত্রসহ ৩৯ জন।

রাশেদের মায়ের মতো সকালে আদালতে আসেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা মশিউর রহমানের বাবা শফিকুল ইসলাম। পেশায় তিনি একজন রিকশাচালক। ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এক মাস হলো বাড়ি ফেরেননি। বড় ছেলের কাছেই থেকেছেন। এই যে রিকশাচালক বাবারা, পরের বাড়িতে কাজ করা মায়েরা কত কষ্ট করে সন্তানকে পড়ান, সেই খবর আমাদের রাজনীতিকেরা রাখেন না। মন্ত্রীরা রাখেন না। রাখলে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা যৌক্তিক আন্দোলনটি অনেক আগেই মধুরেণ সমাপয়েৎ হতে পারত।

রাশেদদের জামিন নিয়েও নানা তৎপরতা চলে। রোববার নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী ৪২ জন শিক্ষার্থীর জামিন হওয়ার পর অনেকেই আশা করেছিলেন, ঈদের আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদেরও জামিন হবে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে একবার তাঁদের মামলার শুনানি হয়। তখন আদালত আইনজীবীকে বলেন, উচ্চ আদালতে যেহেতু জামিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে, সে কারণে তিনি শুনানি নিতে পারেন না। উচ্চ আদালত থেকে ওই আবেদন প্রত্যাহার করা হলে তিনি জামিন শুনানি গ্রহণ করতে পারবেন। যখন রাশেদদের আইনজীবী আদালতের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন, জানতে পারেন জামিন হয়নি, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন রাশেদের মা সালেহা বেগম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক নেতা তারিকুলের বাবা শফিকুল ইসলামের কান্নাও থামিয়ে রাখা যায়নি। কিন্তু বিকেল চারটার দিকে এই দৃশ্যপট বদলে যায়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রাশেদদের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আদালতকে জানান, উচ্চ আদালতে করা জামিনের সেই আবেদন প্রত্যাহার করে এনেছেন। যাঁদের গ্রেপ্তার হয়েছে, সবাই ছাত্র। এক মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন তাঁরা। আদালত শুনানি নিয়ে রাশেদদের জামিন দেন ঢাকার মহানগর হাকিম শরাফুজ্জামান আনসারী। তখনই রাশেদের মা, তারিকুলের বাবাসহ অনেকের চোখে-মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

ছাত্ররা আন্দোলন করেছিলেন কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা স্বীকার করেছেন, ছাত্রদের এ আন্দোলন যৌক্তিক। তারপর সেই যৌক্তিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের কেন গ্রেপ্তার করা হলো, কেন তাদের জেল খাটতে হলো? রাশেদ যখন কারাগারে, তখনই সালেহা বেগম সরকারের কাছে এই আরজি জানিয়েছিলেন যে ঈদের আগে যেন তাঁর ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেলেকে কারাগারে রেখে তিনি ঈদ করতে পারবেন না। ছাত্রদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশি-বিদেশি লেখক-বুদ্ধিজীবীরা। দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও কলাম লিখেও তাদের মুক্তি চাওয়া হয়েছে।

সালেহা বেগম বলেছেন, ‘আমার সন্তান কোনো অপরাধ করেনি। ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করেছে। তারপরও কেন তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে মারধর করা হবে?’

আদালত থেকে যখন পুলিশ রিমান্ডে রাশেদকে ডিবি অফিসে নিয়ে আসত, সালেহা বেগম গেটে অপেক্ষা করতেন। যদি একবার সন্তানের মুখ দেখতে পান। একবার রাশেদ তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওরা যেন আর না মারে।’ তাঁর বিরুদ্ধে বিতর্কিত ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে। তিনি যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বলে থাকেন, সেটি বলেছেন আন্দোলনের স্বার্থে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী কোটা থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কোটা না রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছে। তাহলে শিক্ষার্থীরা কী দোষ করলেন? কেন তাঁদের কারাগারে থাকতে হবে।

যা-ই হোক, ঈদের আগে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্ররা জামিন পেয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের কথা। সরকারকে এ জন্য ধন্যবাদ জানাই যে তারা অন্যান্য মামলার মতো জামিনের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু আমরা মনে করি, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জামিন পাওয়াই যথেষ্ট নয়। তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

ঈদের আগে শিক্ষার্থীদের মুক্তির খবর শুধু ওই পরিবার নয়, সারা দেশের মানুষের জন্যই একটি আনন্দের সংবাদ। সন্তানের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করে সালেহা বেগম হয়ে উঠেছেন সবার মা। এই মাকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।