নামটি 'বাংলা প্রদেশ'ও হতে পারত

সাংবাদিক কামাল আহমেদ গত ২৯ জুলাই প্রথম আলোর মতামত কলামে পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রস্তাবিত নাম ‘বাংলা’ নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সাম্প্রতিকতম প্রস্তাব দুই বছর আগের অন্য প্রস্তাব থেকে একটু আলাদা: আগের বারে বিধায়কেরা তিন ভাষায় রাজ্যের নাম কী হবে (বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি), তা ঠিক করে দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে এখন একটিমাত্র নাম ‘বাংলা’ প্রস্তাব করা হয়েছে তিনটি ভাষায়।

কামাল আহমেদের লেখায় যে কথাটি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, তা এই: ‘বাংলাদেশ এবং ভারতীয় ভূখণ্ড পশ্চিমবঙ্গ উভয় ভূখণ্ডেই বাংলা কথাটির সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে আছে।’ বিধায়কেরা এই আবেগকে একেবারেই পাত্তা দেননি। এমন নয় যে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এ ধরনের নামকরণের জন্য পথে নেমে অনাহার ধর্মঘট শুরু করেছিলেন।

 পশ্চিমবঙ্গের শুধু ‘বাংলা’ নামকরণ একধরনের আধিপত্যবাদী অনুষঙ্গ নিয়ে আসে। র‍্যাডক্লিফ লাইনের দুই ধারের বিষয়াদি আর আবেগ এমনই যে, এক ধারের যেকোনো ক্রিয়া অন্য ধারে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ওপারে কিছু হলে আমাদের তাতে কিছুই আসে-যায় না—ব্যাপারটা অত সরল নয়। কখনো তাতে বিরূপ সাড়া জাগে, আবার কখনো আসে অভাবিত মাত্রার সমর্থন। ১৯৫২, ১৯৭১ বা এই সেদিন জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্থান করে দেওয়ার প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গের সমর্থন প্রমাণ করে নাড়ির শক্ত বাঁধন।

দু-একজন বলতে চেয়েছেন, পানীয় ‘বাংলা’এর সঙ্গে মিলে যায় এমন নামটি না আনলেও চলত। কয়েক বছর আগের একটা হিসাবে দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের মোট আবগারি শুল্ক বাবদ আয়ের ৩৯ শতাংশ আসে বাংলা মদ বিক্রি থেকে। পৃথিবীতে হয়তো এই একটাই উদাহরণ যে জনগোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা বা দেশের নামের মতোই কিছুটা অবজ্ঞামিশ্রিত একটা পানীয়র নাম যুক্ত হয়েছে অভিন্ন বানানে। এই পানীয়র নাম রাজ্যটির নতুন প্রস্তাবিত নামকে অংশত হলেও হেয় করবে বলে অনেকে মনে করেন।

বিধায়কদের জন্য অন্য পথও খোলা ছিল। আগে বহুদিন ‘বাংলা রাজ্য’ নামটি বিবেচনায় ছিল। কিন্তু সে পথে যাননি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান নিয়ন্ত্রকেরা। ভারত প্রজাতন্ত্রের পাঁচটি রাজ্যের নামের সঙ্গে ‘প্রদেশ’ শব্দটি আছে, যার মধ্যে উত্তর প্রদেশ প্রায় কুড়ি কোটি লোক নিয়ে জনসংখ্যায় পৃথিবীর গোটা ছয়েক স্বাধীন দেশ বাদে অন্য সব দেশের ওপরে—গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে বেশি এবং পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণ। সুতরাং সহজেই এই প্রস্তাবিত নাম ‘বাংলা প্রদেশ’ হতে পারত। বাংলা প্রদেশ হলে অন্য ভাষায় কীভাবে লিখতে হবে, সেই এখতিয়ারবহির্ভূত ভাষা-চর্চায় না গিয়ে হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশের পাশে বাংলা প্রদেশ যুক্ত হতো এবং সব ভাষাতেই তা নির্দ্বিধায় যেমন বিধায়কদের নির্দেশনার বাইরেই লেখা যেত, তেমনি সংক্ষিপ্তকরণের স্বাভাবিক নিয়মেই হিমাচল বা অরুণাচলের মতো কথ্য ভাষায় তা ‘বাংলা’ই উচ্চারিত হতো। এতে দুই দিকই রক্ষা পেত।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ-এর পাশে থাকার কারণে এতে কি একধরনের হীনম্মন্যতা জন্ম নেবে? এ ধরনের সম্ভাবনা যুক্তিতে টেকে না। মহারাষ্ট্রের নামের সঙ্গে রাষ্ট্র আছে, তা সে যে কারণেই হোক, সে জন্য তা রাষ্ট্রিক মর্যাদায় আসীন হয়নি। তামিলনাড়ুর ‘নাড়ু’ শব্দটি ভূমি বা দেশ অর্থে যুক্ত; মিজোরামের ‘রাম’ও ওই একই অর্থের, মিজোদের দেশ। নাগাল্যান্ডের ‘ল্যান্ড’ তো ইংল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড বা ডয়েটশল্যান্ডকে (জার্মানি) মনে আনে, কিন্তু সে জন্য তো তার আন্তর্জাতিক বা দৈশিক দাম একেবারেই বাড়েনি বা কমেনি।

ওই পাঁচটি ‘প্রদেশ’ বা ‘ল্যান্ড’ বা ‘নাড়ু’ বা ‘রাষ্ট্র’ বা ‘রাম’ ভারত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবেই দুনিয়ায় পরিচিত এবং একই সঙ্গে মহান ভারতীয় ঐতিহ্যের অংশীদার হিসেবে গর্বিত। সে ঐতিহ্য তো আমাদেরও, সাতচল্লিশ বা একাত্তরের পরে অন্য যা-ই হোক না কেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম নয়, ওই ঐতিহ্যের আরও অনেক কিছু আছে, যা আমরা চাইলেও ছাড়তে পারব না। কিন্তু ভারত প্রজাতন্ত্রের সব প্রদেশ বা রাজ্য তার সরাসরি দাবিদার।

নামকরণের বর্তমান প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে খেলো যুক্তি মনে হয়েছে ভারত প্রজাতন্ত্রের মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুযায়ী বক্তব্য প্রদানে পশ্চিমবঙ্গের নাম আসে শেষের দিকে, ইংরেজি ‘ডব্লিউ’ অক্ষরে এবং ফলে অনেক মুখ্যমন্ত্রীই ঘুমিয়ে পড়েন। যে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ ঘুমিয়ে পড়েন, তার প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা বা গুরুত্ব বোঝা কঠিন। পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা সমাধানের জন্য আয়োজকেরা পালা করে একেক রাজ্যকে শুরুতে বক্তব্য দিতে ডাকতে পারেন; সে ক্ষেত্রে সবাই যেমন সর্বশেষে বলার দুঃখ থেকে মুক্তি পাবেন, তেমনি পর্যায়ক্রমে ঘুমানোরও সুযোগ পাবেন। উল্লেখ্য, যাঁরা বর্ণানুক্রমিক পদোন্নতি চাইছেন, তাঁরাই একসময়ে কলকাতা শহরের ইংরেজি বানান তৃতীয় বর্ণ ‘সি’ থেকে নামিয়ে ১১ নম্বরের ‘কে’তে এনেছেন: চিন্তার অসামঞ্জস্য মাথা ঘুরিয়ে দেয়।

আমাদের রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’, একে বুঝতে হবে সেই অর্থে যেমন একসময়ে ছিল জিডিআর বা এফআরজি বা দুটি ভিয়েতনাম। দুটি কোরিয়া এখনো আছে, ‘ডিপিআরকে’ আর ‘আরওকে’ নামে। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ কোনোমতেই রবীন্দ্রনাথের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’র পুরো বাংলাদেশ নয়। তেমনি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র ‘বাংলা’ও প্রস্তাবিত ‘বাংলা’ নয়। সংক্ষিপ্তকরণের স্বাভাবিক নিয়মেই ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ জনগণের ভাষায় ‘বাংলাদেশ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু তা কখনোই রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশের পুরোটার দাবিদার হয়ে দাঁড়ায়নি, তা তো ভৌগোলিকভাবে মূলত অবিভক্ত বাংলার পূর্বাংশ বা ‘পূর্ববঙ্গ’। আমাদের সংবিধানে আনুষ্ঠানিক নামটির পুরোটাই আছে। পশ্চিমবঙ্গ নামটিও দীর্ঘ সাত দশকের। এর গ্রহণযোগ্যতাও যথেষ্ট। একটা ‘পশ্চিমবঙ্গে’র উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে একটা ‘পূর্ববঙ্গ’ও আছে, তার সাংবিধানিক নাম যা-ই হোক না কেন।

আখতার হোসেন খান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব