ডিবিতে আটকে রাখা

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বেআইনিভাবে আটকে রেখে ‘নির্যাতনের’ যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা দেশের সব স্তরের মানুষকে গভীরভাবে বিচলিত, বেদনাহত ও স্তম্ভিত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অজ্ঞাতপরিচয়ে গ্রেপ্তারের টানা পাঁচ দিন পরে সন্তানদের আদালতে আনতে অভিভাবকদের আকুল অনুরোধ জানানোর প্রেক্ষাপটে ডিবি গতকাল দুটি পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথমত তারা তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চেয়েছে; দ্বিতীয়ত তারা দাবি করেছে, এই ১২ জন শিক্ষার্থীই ছাত্রশিবিরের কর্মী।

অনেক দিন পরে একসঙ্গে এত বেশিসংখ্যক ‘শিবির কর্মী’ গ্রেপ্তারের খবর দিল আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে অভিযোগের ধরন, বয়স কিংবা তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যা–ই হোক না কেন, ডিবির বিরুদ্ধে বেআইনি পন্থায় শিক্ষার্থীদের ‘তুলে নেওয়া’, পাঁচ দিন আটকে রাখার পর রোববার ‘গ্রেপ্তার’ দেখানো এবং তাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালানোর যে অভিযোগ উঠেছে, সেটা তারা এখন পর্যন্ত খণ্ডন করতে পারেনি। গতকাল এ বিষয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবে যেসব ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা তেমন বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়নি।

এই প্রশ্ন এখন ক্রমশ জ্বলন্ত হয়ে উঠছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে এমন কিছু স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটছে, যাতে এটা অনুমান করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে যে আইন অমান্য করে চলার মতো সিদ্ধান্তগুলো আসলে কে বা কারা, কী উদ্দেশ্যে নিচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় এসেছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি, পুলিশের রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুরের ঘটনাই বেশি। সুতরাং চার দিন বিলম্বে আদালতে পাঠিয়ে দুদিন রিমান্ড পাওয়ার মতো ঘটনা গা সওয়া ব্যাপারে পরিণত হওয়ার আগেই আমরা কায়মনোবাক্যে আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগের স্বতঃপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ কামনা করি।

আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের বিরুদ্ধে সারা দেশে পাইকারি ধরপাকড় করার যে অভিযোগ আছে, তা থেকে আমরা ডিবির মতো এলিট সংস্থার আচরণ ও মনোভাবকে কি কিছুটা হলেও পৃথক করতে পারব না? আশঙ্কা করা চলে যে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে যেন বাসা বাঁধতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি টিআইবির খানা জরিপে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। সে কারণে জনপ্রশাসনের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এখনই এ বিষয়ে সজাগ হওয়া দরকার। কারণ, এমন সন্দেহ করার কারণ আছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ভেতরে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার মান ক্রমশ নিচে নামছে। এ ধরনের পরিস্থিতির বিপদ হলো, অসাধু কিংবা উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশীর্বাদ আছে ধরে নিয়ে তারা অপরিণামদর্শী অথচ বেপরোয়া পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা দেখাতে পারেন। ১২ শিক্ষার্থীর প্রতি সর্বতোভাবে যে বেআইনি ও নির্দয় আচরণ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, তার কোনোই দরকার ছিল না।

১৯৯৮ সালে পুলিশি হেফাজতেইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলেরআলোচিত মৃত্যুর পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন যেসব সুপারিশ করেছিল, তা আমরা অগ্রাহ্য হতে দেখেছি। সে ঘটনার সূত্রেই পরে আমরা গ্রেপ্তার ও রিমান্ড বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের তরফে নির্দিষ্ট গাইডলাইন পেয়েছি। সেই গাইডলাইন প্রায় সব ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়েছে। ডিবি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’–এর বরাতে যা জানা সম্ভব হয়েছে বলে গতকাল দাবি করেছে, তা রিমান্ডে বৈধভাবে জানা গেলে খুব কি ক্ষতি হতো? এসব ঘটনায় আইন না মেনে খামোখা যারা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের ভাবমূর্তির জন্য জরুরি।