নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী ৩০ অক্টোবরের পর যেকোনো দিন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। তা যদি হয়, তবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু হবে এবং তার পরের ২১ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আয়োজন। প্রশ্ন হলো, এই আয়োজনের কতটা প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে; প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো এ মুহূর্তে কী অবস্থায় রয়েছে; নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়ে অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন কতটা সচেতন রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে বলা হয়েছে, ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ১০ কোটি ৪১ লাখ ভোটারের তালিকা তৈরি, ভোটকেন্দ্রগুলোর খসড়া তালিকা প্রকাশসহ নির্বাচনের প্রস্তুতির ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এগুলো অবশ্যই সুসংবাদ। তবে শুধু কারিগরি, লজিস্টিক ও ব্যবস্থাপনাগত প্রস্তুতিই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করে না, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাথমিক পূর্বশর্ত হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ও অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সুযোগ না পেলে নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বেই তারা সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার যথেষ্ট মাত্রায় ভোগ করতে পারছে না, সরকারের তরফ থেকে নানা বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ স্থানে তাদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হয়, নেতা-কর্মীদের আটক করা হয়, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা হয়রানি করা হয় বলে তাঁরা অভিযোগ করে আসছেন।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানির সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে দলটির সোমবারের কর্মসূচির কথা উল্লেখ করা যায়। সেদিন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ বাধা দিয়েছে। ঢাকায় বাধা দেয়নি, কিন্তু ধরপাকড় করেছে। সেদিন পুলিশ সারা দেশ থেকে বিএনপির দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করেছে। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন সামনে রেখে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতিমূলক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে; এই ক্ষেত্রে নানা সরকারি পদক্ষেপ, এমনকি সরকারি তহবিল ব্যবহারেরও খবর বেরিয়েছে। ভোটার আকর্ষণের লক্ষ্যেই সাংসদদের নির্বাচনী এলাকাগুলোতে নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, যা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ক্ষুণ্ন করবে। এ ছাড়া ভোটের আগে ব্যবসায়ীদের নানা রকমের সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার যেসব পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছে, তা-ও নির্বাচনী ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। কারণ, ব্যবসায়ীদের অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেবেন।

সরকারের যেসব পদক্ষেপ নির্বাচনে সব পক্ষের সমান সুযোগের ক্ষেত্র ক্ষুণ্ন করতে পারে বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে, সেসব সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের কোনো বক্তব্য এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ে কার্যকরভাবে কিছু করার সুযোগ না থাকলেও কমিশন বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত এবং তার ফলে এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সচেতনতার প্রকাশ ঘটত। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এ ক্ষেত্রে কমিশনকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে সরকার বদ্ধপরিকর, তবে সরকারকে সেই সহযোগিতামূলক ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে কমিশনকে তৎপর হতে হবে।