রাশিয়া-চীনের গাঁটছড়া কত দিন টিকবে?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: রয়টার্স
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: রয়টার্স

চলতি সপ্তাহের গোড়ার দিকে সাইবেরিয়ায় রাশিয়া তার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ মহড়া দিয়েছে। ‘ভোস্তক’ নামের এই মহড়ায় রাশিয়ার সঙ্গে চীন ও মঙ্গোলিয়ার সেনাবাহিনীও ছিল। এতে রাশিয়ার তিন লাখের বেশি সেনা এবং এক হাজারের বেশি যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি অগণিত ট্যাংক ও যুদ্ধজাহাজ অংশ নিয়েছে। বেইজিং তিন হাজার সেনা এবং বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবিমান ও জাহাজ পাঠিয়েছে। চীন ও রাশিয়ার এটিই সর্বকালের সবচেয়ে বড় যৌথ মহড়া।

মহড়াটি এমন এক সময়ে হলো যখন মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ এবং সিরিয়া ও ইউক্রেনে রুশ সেনাদের উপস্থিতির জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা বাড়ছে। অন্যদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক বৈরিতার দিকে যাচ্ছে। এই ভোস্তক মহড়া আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মনে এই ধারণা তৈরি করেছে যে, বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পশ্চিমাদের খবরদারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য রাশিয়া ও চীন এককাট্টা হচ্ছে।

পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ওয়াশিংটন এবং ইউরোপে তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা রাশিয়ার ওপর যেসব অবরোধ আরোপ করেছে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীনের সঙ্গে মস্কোর মৈত্রী গড়ে তোলারই কথা। অন্যদিকে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ সৃষ্টি করেছে এবং পূর্ব চীন সাগরের সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ জাপান বেইজিংকে যে চাপের মধ্যে রেখেছে, তা থেকে বাঁচতে চীন বৃহৎ সামরিক শক্তির দেশ রাশিয়াকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।

এ বছরের শুরুতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বেইজিং সফরের সময় দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হয়। দুই পক্ষের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, সব ক্ষেত্রে দুই দেশ সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়াবে; বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর কৌশলগত সক্ষমতা ও সামর্থ্য বাড়াতে এবং ভূরাজনৈতিক কৌশল নিজেদের অনুকূলে রাখতে তারা একে অপরকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।

এ বছরেই দুই দেশের মধ্যে ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়েছে। দুই পক্ষ থেকেই আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এই বাণিজ্য বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তবে দুই দেশের এই মৈত্রী ও সুসম্পর্ককে সতর্কতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। কারণ, দেশ দুটি বহুদিন আগে থেকেই পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। পারস্পরিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে তারা কাছাকাছি এলেও ভেতরে-ভেতরে সেই অবিশ্বাস ও অনাস্থা এখনো রয়ে গেছে।

প্রথমত, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় চীন যে আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা করেছে, সে বিষয়ে মস্কো সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়া চীনের বিআরআই প্রকল্পের অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে কারিগরি সহায়তা দেবে বলে ঠিক হয়ে আছে। সেই মতো চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু চুক্তির বাইরে চীন এই প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে রাশিয়ার আধিপত্য থাকা এলাকায় খবরদারি করার সুযোগ পেয়ে যাবে কি না, সে বিষয়ে মস্কো সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। বিশেষত, দূরপ্রাচ্যে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোকে মোটেও ভালোভাবে নিচ্ছে না রাশিয়া। কারণ, এর ফলে আর্কটিক অঞ্চল রাশিয়ার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

আরেকটি বিষয় হলো, সম্প্রতি জাপানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো হয়ে ওঠাকে চীন গভীর সন্দেহের নজরে দেখছে। জাপানের উত্তর উপকূলীয় অঞ্চলের দক্ষিণ কুরিল দ্বীপের মালিকানা নিয়ে জাপানের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব বহু দিনের। দুই দেশই এই দ্বীপকে নিজেদের দাবি করে আসছে। এ নিয়ে এখনো কোনো ফয়সালা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুতিন ও শিনজো আবে সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করছেন। কুরিল নিয়ে বিতর্ক থাকার পরও তাঁদের এই কাছে আসা এটি ইঙ্গিত করে যে, জাপান পুরো এলাকা বেইজিংয়ের হাতে ছেড়ে না দিয়ে দূরপ্রাচ্যে সে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে বেশি আগ্রহী।

সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি রাশিয়া ও চীন ভালোভাবেই বিবেচনায় রেখেছে। দুটি দেশই জানে, এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যত দিন মার্কিন উপস্থিতি থাকবে, তত দিন ওয়াশিংটন তাদের উভয়কেই দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করবে। সেই জায়গা থেকে তারা কেউই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। পরিস্থিতি বদলে গেলে যেন তারা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে জন্য নিজেদের সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম ফাঁক তারা বজায় রেখে চলবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

জে বার্কশায়ার মিলার: ইস্ট ওয়েস্ট ইনস্টিটিউটের পূর্ব এশিয়াবিষয়ক ফেলো