একচোখা অ্যাকটিভিজমের বিপদ

হলিউড-বলিউডজুড়ে ‘#মি টু’র তোলপাড় চলছে। মিডিয়াও সরগরম। জিনিসটা কী, অনেকেই জানেন। যৌন হয়রানি ও যৌন আক্রমণের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন। তারানা বুর্কে, যিনি একজন আমেরিকান সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট, তিনি ‘#মি টু’ শুরু করেন ২০০৬ সালে। অনেক বছর পর আমেরিকান অভিনেত্রী আলিশা মিলানো ২০১৭ সালে তাঁর টুইটারে পোস্ট দেন নিজের ওপর যৌন হয়রানি প্রসঙ্গে। ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর মিলানো টুইট করেন। লোকজন এক দিনেই তা ২ লাখ বার দেখেন। অক্টোবর ১৬-তে সেই সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৭ লাখে। এই লোক বাড়ে মাত্র ২৪ ঘণ্টায়।

এরপর চার্চ থেকে শুরু করে ফিন্যান্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রি, রাজনীতির অঙ্গন থেকে সরকারি পরিমণ্ডলে তা ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত। খেলার জগতেও তোলপাড় শুরু হয় ‘মি টু’ নিয়ে। ২০১৬ সালে আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির জিমনাস্ট ল্যারি নাসনকে যৌন হয়রানির দায়ে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছে। মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রিতেও প্রভাব ফেলে এই প্রচার। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বা আরও অনেক কর্মক্ষেত্রেও। যেখানেই নারীর বিচরণ, সেখানেই। হলিউডে আন্দোলনটি শুরু হলেও দেখা যায়, সবখানেই সব কর্মক্ষেত্রই নারীর জন্য অনিরাপদ। লক্ষ্য করার বিষয়, এটি ২০১৮ পর্যন্ত এসে কীভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। আর যা-ই হোক, কিছুতেই তা হলিউডের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি।

এখন বাংলাদেশের মতো জায়গাতেও নারী সামনে আসবেন এবং তাঁর যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা জানাবেন ও প্রতিবাদ করবেন, তা প্রত্যাশিত। বর্তমান বাংলাদেশে নারী পাবলিক স্পেসে গিয়ে আয়-উপার্জন করেন, সংসার চালান। গরিব নারী তো বটেই, মধ্যবিত্ত নারীরাও। বাসে, পথে, বাজারে এমনকি নিজের কর্মক্ষেত্রেও তাঁর যাতায়াত অবাধ নয়। পরিবারেও নয়। পরিস্থিতি এমন হলেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বেলায় ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কেবল মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির কথাই সামনে আসে। তাতে অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীদের চলাচলের অসুবিধাগুলো তো আড়ালে পড়েই, উপরন্তু সমস্যাগুলো ‘মুখরোচক গল্প’ আকারে গণমাধ্যমে আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিটা আসলে খোদ পুরুষতন্ত্রের নির্মাণ।

বাংলাদেশে প্রচুর নারী শ্রমিক আছেন এবং তাঁদের নানানভাবেই কটু কথা আর বাজে পরিস্থিতির মধ্যেই কাটাতে হয়। কর্মক্ষেত্রে যেমন, রাস্তাঘাটে বা যানবাহনে সেসব খবর বা আলোচনা খুব সামান্যই হাজির হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠন তুলনামূলকভাবে ভালো বলে ধরে নেওয়া যায়। নানান নিপীড়ন ও নির্যাতনের মধ্যেও তাদের সংগঠন কাজ করছে। তারপরও তাঁদের সেসব যৌনাত্মক নিপীড়নের অভিজ্ঞতার সামনে পড়তে হয়, যা খুব একটা আলাপিত হয় না। বড়জোর অন্যান্য সংগ্রামের কথা আলাপ হয়। আবার মিডিয়ার মেয়েদের ‘মি টু’-কেন্দ্রিক আলাপে তাঁদের যে নিত্যদিনের বৃহত্তর সংগ্রাম, সেটাও কিছুতেই সামনে আসে না। বরং নতুন করে একটা বৈষম্য দানা বাঁধে।

এই কথা তুললাম এ জন্য যে, প্রায়ই টক শো বা এ ধরনের অনুষ্ঠানে মিডিয়ার মেয়েদের সমরূপ অভিজ্ঞতার কথা এলেও আসে না করপোরেট সেক্টরের কথা কিংবা গার্মেন্টস কারখানার মেয়েদের কথা। এই বারবার আসার সঙ্গে একটা প্রচলিত গতের (স্টিরিওটাইপ) সম্পর্ক পাই আমি। সেটা হলো মিডিয়াতে ‘ভালো পরিবারের’ মেয়েরা আসে না; তাই এমনটা তো ‘ঘটতেই পারে’। এক তো ‘ভালো পরিবারের’ ধারণাটাই অত্যন্ত বিপজ্জনক। দ্বিতীয়ত, নিপীড়নের বিষয়টা বুঝলে কে কোথা থেকে আসছে, তা গৌণ প্রসঙ্গ। গণমাধ্যমগুলোর এই পরিস্থিতি তৈরিতে দায় আছে বলেই আমি মনে করি। এ রকম একটা বিষয় নির্বাচন কিছুতেই সমমর্মী হওয়ার জন্য নয়, বরং কাটতি বাড়ানোর জন্য, পুরুষালি মনের কাছে আরও জনপ্রিয় হওয়ার জন্যই বাছাই করা হয়।

সমাজের কোনো স্তরেই লিঙ্গীয় সমতা বিধান হয়নি। কীভাবে সমতা নিশ্চিত করা যায়, তার কিছু ধারণা থাকা সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিক বাধায় তার চর্চা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এটাও নির্ধারণ আমাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে যে, কোন কোন জায়গায় সঠিক বিচার-বিবেচনা এই সমতা নিশ্চিত করতে পারবে। রাষ্ট্র? সমাজ? আইনি কাঠামো? প্রায়ই বলা হয়ে থাকে পারিবারিক শিক্ষার কথা। একটা ধারণাও আছে, বাংলাদেশে ‘পারিবারিক মূল্যবোধ’ শক্তিশালী। কোন দেশে নয়? আর পরিবারের শিক্ষা কি রাষ্ট্রের বিধিব্যবস্থা থেকে খুব স্বতন্ত্র হয়? সবটাই তো পরিপূরক। বরং রাষ্ট্রের শিথিলতার মধ্য দিয়ে পরিবারে আরও আরও অসমতার চর্চা সম্ভব হয়ে ওঠে।

অনেকেই ভাবছেন ‘মি টু’ আন্দোলনে নারী শামিল হচ্ছেন ফোকাসে আসার জন্য। হ্যারাসমেন্টের কাহিনিগুলো জানিয়ে নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করছেন, এ রকম অভিযোগ আছে। আবার অনেকেই মনে করছেন, এই নিস্তব্ধতার অবসানটাও জরুরি। এক শ্রেণির পুরুষের সস্তা নিন্দাগুলো যদি বাদও দিই, তারপরও এই প্রশ্নটা আসে, কেবল এই হ্যাশট্যাগ ও সাইবার স্পেসে প্রকাশ করে খুশি থাকা কি যথেষ্ট? দীর্ঘদিন এই খুশি থাকার অভ্যাস তো আসলেই নেতিবাচক প্রভাব আনবে। যখন সমতার বিধান হয় না, যখন সমতার বিধানের বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না বা বাধাগ্রস্ত হয়, তখন এসব অভ্যাস উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। এসব কথা তোলার কারণে চাকরিচ্যুত হচ্ছেন খোদ নারীই—এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমি কেবল সেই উল্টো ফল নিয়ে বলছি না। বড় কোনো রদবদল ছাড়াই, নতুন যুগের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে, নিজের নিপীড়িত হওয়ার গল্পটিই শুধু বলা যদি রাজনৈতিক অভ্যাস হয়ে পড়ে, তাহলে সেটা লিঙ্গ-রাজনীতির জন্য ভালো হবে না বলেই আমার মনে হয়।

নারীবাদীদেরই কেউ কেউ মনে করতে শুরু করেছেন যে খুব দ্রুত ‘মি টু’ বালখিল্য হয়ে পড়েছে বা পড়তে যাচ্ছে। আগ্রহী পুরুষ শ্রোতার কারণে যেমন, এর পৌনঃপুনিকতার কারণেও; আর কোনো কর্মপদ্ধতি গড়ে না তোলার কারণেও। আমার বক্তব্য, নিজের নিপীড়িত অবস্থার প্রকাশ বড়জোর ‘লজ্জা’ বা ‘শরমের’ সামাজিক বিধান ভাঙা হয়, সমতার বিধান কিংবা যৌন নিপীড়নহীন ব্যবস্থার লড়াইয়ে শামিল হওয়া হয় না। বরং তার দীর্ঘ চর্চা পুরুষতন্ত্রের কাছে ‘লোভনীয়’ আর অকেজো অস্ত্র হতে পারে।

আমার আরও একটা বক্তব্য আছে। বাংলাদেশের মতো জায়গায়, যেখানে এই ‘আন্দোলন’ মানুষজনকে মূলত মিডিয়া (মিডিয়ার মেয়ে) নিয়েই আগ্রহী করেছে, সেখানে ‘মি টু’ আরও ক্ষতি বয়ে আনতে পারে নারীবাদের জন্য। একটা পেশাকে নিশানা করার মানেই হলো বৃহত্তর নারীর লড়াইকে উপেক্ষা করা হচ্ছে; আর নারীর বিপদকে কেবল যৌন বিপদ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এতে এই পেশার নারীদের দাগাঙ্কিত/কলঙ্কিত (স্টিগমাটাইজ) হওয়ার সম্ভাবনা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি নারীবাদও বাগাড়ম্বরের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে এবং নারীবাদ নিয়ে পুরুষের গৎবাঁধা ধারণাগুলো (স্টিরিওটাইপ) শক্তিশালী হতে পারে।

নকল করা সাইবার আন্দোলনগুলো নিয়ে আসলেই আরও ভাবা দরকার।

বন্যা মির্জা: অভিনেত্রী