এভাবেই পাশে থাকুন উচ্চ আদালত

বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ চার বছর আগে দেওয়া হাইকোর্টের একটি আলোচিত আদেশের উল্লেখ করে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে সেই আদেশের কারণেই নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার বিচার সম্ভব হয়েছে। গতকাল সোমবার হাইকোর্ট ৭৩৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন। এই রায়ে লেখা হয়েছে, ‘যদি সেদিন অভিযুক্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে হাইকোর্ট আদেশ না দিতেন, তাহলে এর বিচার করা সম্ভব হতো না।’

আমরা এখন স্মরণ করতে পারি, হাইকোর্টের সেই আদেশকে বিচারকদের অপসারণসংক্রান্ত বিধান সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে সংসদের কাছে ন্যস্ত করানোর অন্যতম অনুঘটক হিসেবে অনেকে উল্লেখ করেন। সংবিধানের সেই ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগসহ অনেক ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। কিন্তু সেই সংশোধনী আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। 

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর দুজন ও নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এই তিন কর্মকর্তাকেই কিন্তু হাইকোর্ট গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে সরকারি প্রশাসনের কোনো কোনো অংশ বিব্রত হয়েছিল। তাঁরা হলেন র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন ও নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের সাবেক প্রধান লে. কমান্ডার এম এম রানা। সেনাবাহিনীর দুজনকে অকালীন ও নৌবাহিনীর একজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তাকে অকালীন অবসর দিয়ে বলা হয়েছিল, নিয়ম অনুসারে তাঁরা চাকরি যাওয়ার পর এক বছর (প্রাক্‌-অবসরকালীন ছুটি—পিআরএল) সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। তাঁরা এক বছর সেনানিবাসের বাসাও ব্যবহার করতে পারবেন। হাইকোর্টের আদেশের পর ২০১৪ সালের ১২ মে প্রথম আলোয় এই খবর দিয়ে বলা হয়েছিল, এতে ধরে নেওয়া হয়েছে, দুই কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর বাসাতেই আছেন। নৌ সদর দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, চাকরি হারানো কর্মকর্তা লে. কমান্ডার এম এম রানা নৌবাহিনীর বাসায় নেই। বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার পর তিনি কাগজপত্র নিয়ে চলে গেছেন। এখন তিনি কোথায় আছেন, তা নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা জানেন না। পরে তাঁরা গ্রেপ্তার হন। হাইকোর্টের আদেশের পরে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনে সোপর্দ করতে সহায়তা দিয়েছিল। 

‘এই মামলা অপরাধের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এই মামলার বিচার স্পষ্ট করেছে যে ব্যক্তির অবস্থান যা–ই হোক না কেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’ মন্তব্য করেছেন আদালত। নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালতের মতো হাইকোর্টও অভিন্ন কণ্ঠে বলেছেন, একটি অভিজাত বাহিনী হিসেবে র‌্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। তারা জনগণের আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক। অপরাধ যেটা ঘটেছে, সেটা বিচ্ছিন্নভাবে কতিপয় বিপথগামী সদস্যকেই নিতে হবে। তাঁরা ব্যক্তিস্বার্থে অপরাধ করেছেন।


হাইকোর্টে ২০১৪ সালের শুনানিতে কামাল হোসেন বলেন, ‘বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের সবচেয়ে বড় মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এসব অধিকার কার্যকরে দেশের যেকোনো নাগরিকের হাইকোর্টে আসার অধিকার আছে। দেশে একের পর এক গুম, অপহরণ, হত্যার ঘটনা ঘটছে। এই অবস্থায় আমরা অসহায় হতে পারি না।’ কামাল হোসেন বলেন, ‘এর আগে এ বি সিদ্দিককে অপহরণ করা হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত তাঁকে আমরা ফেরত পেয়েছি। চন্দন সরকার পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির একজন আইনজীবী। তাঁকে প্রকাশ্যে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়।’ শুনানিতে কামাল হোসেন বলেন, শুধু ২৭ এপ্রিলের ঘটনাই নয়, এর আগেও বিনা বিচারে হত্যা, খুন ও গুমের ঘটনা ঘটেছে। অনেকের লাশ পাওয়া গেছে, অনেকের যায়নি। নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র যথাযথ ভূমিকা পালন করবে বলে সংবিধান নিশ্চয়তা দিয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, কারও লাগামহীন ক্ষমতা নেই।

এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় পাঠ করে যেকোনো বিবেকবান মানুষ স্তম্ভিত হবেন। একজন লে. কর্নেল অনেক বড় পদ। তেমন একজন বড় মাপের অফিসার হয়ে তিনি প্রতিটি ক্রাইম সিনে নিজে হাজির ছিলেন। এমনকি তিনি বলছেন, সব দায়দায়িত্ব তাঁর ও মেজর আরিফের। এই রায় থেকে দেখছি, নিহত ব্যক্তিদের মেরে ফেলতে তাঁদের সুকসা ইনজেকশন দিয়েছিলেন। এবং আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তার সত্যতা চ্যালেঞ্জ করেননি। রায়ে বলা হয়, গ্রেপ্তারের পরে জিয়াউল আহসানকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে কর্নেল তারেক বলেছিলেন, ‘অ্যারেস্ট ইজ নিল।’ অর্থাৎ তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অসত্য বলেছিলেন। 

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর রুল জারির পাশাপাশি পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) প্রতি এ আদেশ দেন। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। 

তবে উচ্চ আদালতের এই আদেশ পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছানোর নিয়েও নানামুখী খবর বের হয়েছিল। পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, আদালতের আদেশ শোনার পর তাঁরা যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু রাত পর্যন্ত কোনো আদেশ তাঁদের হাতে আসেনি। আদালতের আদেশ পেলেই তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

এই রায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি অনুসরণীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]