কক্সবাজার-টেকনাফে রাজার ভোট

ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ। এখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আর সাবেক উর্দুভাষী অবাঙালিদের কথা বাদ দিলে প্রায় সবাই একই ভাষায় কথা বলে। তবে ভাষা এক হলেও তার নানা রূপ-রূপান্তর আছে। হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, বদনা, ঝাড়ু, মুড়ি, খাগড়াই ইত্যাদি নিত্যদিনের জিনিস এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।

একই ভাষায় একই ভূখণ্ডে এমন অভিধানবহির্ভূত বিশেষ্য-বিশেষণের সংলাপ আর কোনো ভাষায় আছে কি না, তা পণ্ডিতেরা বলতে পারবেন। তবে চর, উপকূল থেকে সমতল, পাহাড় থেকে দ্বীপ-বদ্বীপের সাধারণ মানুষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে রাজার ভোট বলে একনামে, এক ভাষায় ডাকে। ইলেকশন, ভোট, নির্বাচন—যে শব্দ দিয়েই প্রতিক্রিয়া বা সাংবাদিকের ভাষায় ‘অনুভূতির’ সুলুক সন্ধান করুন না কেন, সাবজেক্ট বা উত্তরদাতা পরিষ্কার হওয়ার জন্য জানতে চাইবে, ‘আপনি কি আসন্ন রাজার ভোটের কথা বলছেন, না অন্য কোনো ভোট?’ আজকাল হরেক রকমের ভোটে মানুষের জীবন জেরবার হওয়ার পথে। বাজার কমিটি থেকে বার কাউন্সিল—সব জায়গায় ভোট। স্কুলে স্কুলে হচ্ছে স্টুডেন্ট কেবিনেট—সেখানেও ভোট। গণতন্ত্রের রসে টইটম্বুর দেশ, তারপরও কেন সাধারণ নির্বাচনে সাংসদ ঠিক করার ভোটকে রাজার ভোট বলে? ভোট পেয়ে একজন নর বা নারী সাংসদ হলেই কি উনি বা তিনি রাজা হয়ে যান? নাকি রাজারাই কেবল ভোটে দাঁড়ান?

কক্সবাজার সৈকতের ছবিয়াল ১৬ বছরের আবুল কাশেম (আসল নাম নয়) বেড়াতে আসা ভিড়ের মধ্যে থেকে খদ্দের ধরে, তাঁদের ছবি তুলে দেয়, পোজ বাতলে দেয়। নিজে বাঁচতে আর পরিবারের সাতজনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ক্যামেরা হাতে এই-ই তাদের পেশা। কাশেমের প্রিয় খেলোয়াড় মাশরাফি। তাঁর একটা বিজ্ঞাপনের নিচে সুনসান সৈকতে সাতসকালে দাঁড়িয়ে ছিল সে। অন্য বছরের চেয়ে এ বছর পর্যটকের সংখ্যা অনেক অনেক কম। কত কম? আরেকজন ছবিয়াল বছর আঠারোর আলতাফুল (ভিন্ন নাম) সকালের সূর্যের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন, ‘ধরেন সিজনে এই সময় হাজার–বারো শ হয়ে যায়, আজ এখনো নাশতার পয়সা হয়নি।’ কেন এত আকাল খদ্দেরের? আলতাফুলের মনে হয়, স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলে অবস্থার উন্নতি হবে। কাশেমের তা মনে হয় না। কাশেম বলে, ‘গ্যাঞ্জাম সামনে, তাই মানুষ আসছে না।’

কিসের গ্যাঞ্জাম? ভোট আছে না, রাজার ভোট? মানুষ ভয়ে আছে। ভয় আবার কিসের? কাশেম–আলাতাফুলের বাহাস শুরু হয়। আমাদের তিনজনের জটলায় যোগ দেন আরও কয়েকজন ছবিয়াল। আজ আসলেই কাজ নেই, গতকালও ছিল না। ডিসেম্বর মাসে এমন ‘ডাল’ যায় না কখনো। হামিদ, বজলু, হারুন—সবাই চিন্তিত। বজলু বলেন, গত রাজার ভোটেও সিজন ডাল ছিল। সেবার ভোট বর্জনের ডাক ছিল, লাগাতার হরতাল ছিল, যানবাহনে আগুনের ভয় ছিল। এবার সেসব নেই। তবুও ভয় কেন?

২০১৪ সালে সদর আর রামু নিয়ে কক্সবাজার-৩ আসন ছিল ভোটমুক্ত নির্বাচন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেবার যে ১৫৩ জনকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়, সেসব ভাগ্যবানের মধ্যে ছিলেন কক্সবাজার-৩ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাইমুম সারওয়ার কামাল। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন লুৎফুর রহমান কাজল। লুৎফুর রহমান এর আগে দুবার নির্বাচন করেছেন। বিএনপির জোয়ারের বছর ২০০১ সালে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন, ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৭৪৬। আর বিএনপির ভাটার বছর ২০০৮ সালে যখন ধানের শীষের টালমাটাল অবস্থা, তখন তিনি নৌকার প্রার্থীকে ৩৯ হাজার ৯৪২ ভোটে পরাজিত করেন। তাঁর অপর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাবেক সাংসদ, বিদ্রোহী প্রার্থী সহিদুজ্জামান সেবার পেয়েছিলেন ৬৩ হাজার ৬৮ ভোট। অর্থাৎ ২০০৮ সালে এ আসনে আওয়ামীবিরোধী ভোট ছিল ১ লাখা ২৬ হাজার ৪৭৮ (নির্বাচিত লুৎফুর রহমান) + ৬৩ হাজার ৬৮ (বিএনপির বিদ্রোহী)‍= ১ লাখ ৮৯ হাজার ৫৪৬। অন্যদিকে, আওয়ামী প্রার্থী সাইমুম সারওয়ার কামাল পেয়েছিলেন ৮৬ হাজার ৫৩৬ ভোট, যা ছিল মোট কাস্টিং ভোটের ৩১ দশমিক ২ শতাংশ। বিএনপির মনোনীত আর বিদ্রোহী প্রার্থীর মিলিত ভোট ছিল কাস্টিং ভোটের ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

১৯৯১ সালে এক হাজার ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এই আসনে জয়লাভ করলেও আওয়ামীবিরোধীদের প্রাপ্ত মোট ভোটের হার ছিল কাস্টিং ভোটের প্রায় ৭০ শতাংশ। এই অবস্থার তেমন একটা রকমফের হয়েছে, তা বলা যাবে না। কাজেই নিরপেক্ষ পরিস্থিতিতে কামাল-কাজলের ভোটযুদ্ধ উপভোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ২০১৪ সালের আগে যে চারটি নির্বাচন এই আসনে হয়েছে, তার মধ্যে বিএনপি জিতেছে তিনবার আর আওয়ামী লীগ জিতেছে মাত্র একবার। পাশের আসন উখিয়া-টেকনাফ নিয়ে কক্সবাজার-৪-এর ছবিটা একটু অন্য রকম।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মোট চারটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দুটিতে জেতে আওয়ামী লীগ আর দুটিতে বিএনপি। এই আসনে জামায়াতের উত্থান ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৯১ সালে তাদের প্রাপ্ত মোট ছিল মাত্র ৩৯৭; কিন্তু ১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৬০৭। পরের দুই নির্বাচনে জামায়াত সরাসরি প্রার্থী দেওয়া থেকে বিরত থাকলেও তাদের ভোট আওয়ামীবিরোধী প্রার্থীর বাক্সে পড়েছে এবং তারা নিজেরা অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছে। কক্সবাজার-৪ আসনের বর্তমান সাংসদ তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী হওয়ায় তাঁর সহধর্মিণী শাহিন আক্তারকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালে নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বা তাঁকে করানো হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন শাহজাহান চৌধুরী। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছাড়া চারটি নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন এবং দুবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদের নেতৃত্বাধীন অংশ আর মনোনয়ন না পাওয়া বিক্ষুব্ধ অংশ যদি বর্তমান সাংসদের স্ত্রীর পেছনে না দাঁড়ায়, তাহলে এই আসন ধরে রাখা আওয়ামী লীগের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে আছে জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থীর গায়ে হাত তোলার ঘটনা। বর্তমান সাংসদের এ রকম আচরণ জাতীয় পার্টির সমর্থক ছাড়াও স্থানীয় মানুষ ভালোভাবে নেননি।

এসব আলোচনা ঘুরপাক খায় প্রেসক্লাবের টেবিলে, চায়ের দোকানে কিংবা মধ্যবিত্তের খিচুড়ি আড্ডায় এবং বিয়ে বা গায়েহলুদের নাচের ফাঁকে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আর জানুয়ারির প্রথম সপ্তায় যত বিয়ে, বউভাত, গায়েহলুদের তারিখ ছিল, সব এগিয়ে আনা হচ্ছে ঢাকা-কক্সবাজারসহ দেশের সর্বত্র। ১৬ ডিসেম্বরের সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি মিলে যাওয়ায় কয়টা দিনের ব্যবসা হবে কক্সবাজারে, তারপর ভরা সিজনের প্রায় এক মাস সব থাকবে সুনসান। ছবিয়াল থেকে শুরু করে মাঝারি আর সস্তা হোটেল-মোটেলগুলো সেই চিন্তায় অস্থির।

ছবিয়াল কাশেম তার প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফির বিরাট বিজ্ঞাপনী খাম্বার নিচে দাঁড়িয়ে একবার বলেই ফেলে, ‘হিরো আরও বড় হিরো হবে, কিন্তু আমরা খাব কী? কাজ নাই—একদম কাজ নাই, নাশতার পয়সা হয় নাই।’

গওহার নঈম ওয়ারা: শিক্ষক, গবেষক