পুলওয়ামার জবাব যুদ্ধ নয়

হামলার পর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ি
হামলার পর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ি

পুলওয়ামা বিপর্যয়ের পর ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করেছে, এই কঠিন পরিস্থিতিতে কেউ কারও প্রতি দোষারোপ করবে না। সবাই একজোট হয়ে সরকারের পাশে থাকবে। দেশের স্বার্থে সরকার যে পদক্ষেপ নেবে, সবাই তা সমর্থন জানাবে। এখন রাজনীতি করার সময় নয়।

রাজনৈতিক দলের নেতারা ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় যা ঘটেছে, তা অবশ্যই জাতীয় বিপর্যয়। এটা সেই ধরনের বিপর্যয়, যা মুম্বাই হামলা, পাঠানকোট ও উরির সেনাছাউনি আক্রমণ কিংবা সন্ত্রাসীদের সংসদ অভিযানের সমতুল্য। হয়তো কিঞ্চিৎ বেশিই। কেননা, উপত্যকায় আর কোনো সন্ত্রাসী হামলায় একসঙ্গে ৪০ জন সেনানীর মৃত্যু হয়নি। এই পরিস্থিতি যে নিছক রাজনৈতিক তরজাগানের উঠান হতে পারে না, ভারতের রাজনীতিকেরা তা উপলব্ধি করে বিচক্ষণতার পরিচয়ই দিয়েছেন।

এই পরিস্থিতিতে একে ওকে দোষারোপের রাস্তায় হাঁটতে আমিও চাই না। কেন এমন হলো, গোয়েন্দারা কেন আগাম আঁচ পেলেন না, কাদের ব্যর্থ নীতি এ জন্য দায়ী, সেই বিশ্লেষণের সময় এটা নয়। বরং সহজ ও সরল সত্যটা মেনে নিতে হবে। রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ব্যর্থ বলেই সন্ত্রাসীরা সফল হতে পারছে। সাফল্যের খতিয়ান দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। চৌকিদারদের অপদার্থতার সুযোগই চোর-ডাকাতেরা নেয়। প্রহরার ফাঁকফোকর কাজে লাগায়। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি যাদের ধর্ম, তারা সফল। চৌকিদার বা প্রহরীদের ধর্ম পাহারা দেওয়া। তারা ব্যর্থ। অপরাধীদের দোষারোপ করার চেয়ে রক্ষীদের অপদার্থতা মেনে নেওয়া তাই বেশি যুক্তিযুক্ত। এই অপদার্থতা বছরের পর বছর ধরে ঘটছে বলেই কাশ্মীর অশান্ত। পুলওয়ামায় যা ঘটেছে, ক্ষতি ও ব্যাপ্তির বিশালত্ব ছাড়া তা নতুন কিছু নয়।

মানতে হবে আরও একটি সত্য। কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের এই রমরমার মদদদার পাকিস্তান। অতীতের প্রতিটি ঘটনাতেই তা হয়েছে, ভবিষ্যতেও যদি আরও একটা পুলওয়ামা ঘটে, তাহলে তা–ও হবে পাকিস্তানি মদদেই। সেই মদদ কতখানি নির্বাচিত সরকারের উদাসীনতা, কতটা সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর তৎপরতা, কতটাই বা স্রেফ সন্ত্রাসীদের একাগ্রতা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। যে বিষয়টি বিতর্কের অতীত, তা হলো মদদদাতারা সীমান্তপারের বাসিন্দা। যার জন্য তার দায়ভার পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকার অস্বীকার করতে পারে না।

পুলওয়ামার ঘটনার টাইমিংও গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনাটা সেই সময় ঘটানো হলো, যখন সংসদের অধিবেশন শেষ এবং দেশ আরও একটা সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কাশ্মীরে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। সেখানকার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে বাঁক নেবে, অনিশ্চিত। সরকারও দোলাচলে। পাকিস্তানের নতুন সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা এখন নেই। ভোটের আগে কেউ সেই ঝুঁকি নেবে না। অথচ দুই পাঞ্জাবের মধ্যবর্তী কারতারপুর করিডর খোলার তোড়জোড় চলছে। কারতারপুর গিয়ে গুরু নানক দেবের সমাধিস্থলে মাথা ঠেকানো ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ের আজন্মলালিত এক স্বপ্ন। তা বাস্তবায়িত হওয়ার অর্থ মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি ঘটা। সন্ত্রাসীরা কিছুতেই তা চায় না। ওদিকে সংশয়ের ঘন কালো মেঘ ছেয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তানেও। মার্কিন সেনাদের ফিরে যাওয়ার পর যুদ্ধ-দীর্ণ ওই দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য কোন দিকে ঝুঁকবে, অনিশ্চিত। প্রভাব বিস্তারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঠেলাঠেলি চলছে। জয়েশ–ই–মুহাম্মদ নেতা মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসবাদী চিহ্নিত করতে ভারত নতুন করে গা ঝাড়া দিচ্ছে বলে খবর শোনা যাচ্ছে। চীনকে রাজি করানোর জন্য নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় পুলওয়ামা-কাণ্ড বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সন্দেহ নেই, অনেক হিসাব কষে, অনেক ভাবনাচিন্তার পর কাণ্ডটা ঘটানো হয়েছে।

সীমান্তপারের সন্ত্রাস অব্যাহত থাকলে তা মোকাবিলার উপায় তাহলে কী? প্রশ্ন সেটাই। এই ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি তখন চলকে ওঠে। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলে মনে হয়, নিউজ রুমগুলো যেন রণাঙ্গন! পাকিস্তানি এই বেয়াদবির ওষুধ যেন একটাই—যুদ্ধ। এবারও যখন প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী বলে দিলেন, ‘শহীদদের রক্ত বিফলে যাবে না, অপরাধীদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে’ এবং ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ অধিকার সেনানীদের দেওয়া হয়েছে’, তখন মনে হতেই পারে ঢিলের বদলে পাকিস্তানকে এবার পাটকেল খেতে হবে। ২০ বছর আগে ১৯৯৯ সালে ঠিক এমনই ঘটেছিল। কারগিল যুদ্ধ। মে মাসের ভোট পিছিয়ে গিয়েছিল চার মাস। কারগিল যুদ্ধ জয়ের হাওয়ায় ভেসে অটল বিহারি বাজপেয়ি ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন টানা পাঁচ বছরের জন্য।

এবারও যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে, সেই ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে আমি যাচ্ছি না। যুদ্ধ কখনো মঙ্গলদায়ক হয় না। দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সংঘাতের পরিণামও যুদ্ধ হতে পারে না। তা ছাড়া, প্রথম পরমাণু আঘাত না-হানার বিষয়ে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাকিস্তান তেমন কোনো অঙ্গীকার কিন্তু করেনি। ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাছ থেকে তা আশা করাও বৃথা। এই পরিস্থিতিতে বিবেচক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সামনে অন্য কী কী পথ খোলা থাকছে, এই সন্ধিক্ষণে বরং সেদিকে নজর দেওয়া যাক।

চটজলদি কয়েকটা পদক্ষেপ ভারত নিয়েছে, যার উদ্দেশ্য দেশবাসীকে বোঝানো ও আশ্বস্ত করা যে সরকার বসে নেই। যেমন পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে ডেকে বলা হয়েছে, রাশ না টানলে ফল ভুগতে হবে। পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে আনা হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বোঝানো হয়েছে, পাকিস্তানের জন্য ভারত কতটা অসহায় ও পীড়িত। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানকে দেওয়া ‘মোস্ট ফেভারড নেশনে’র মর্যাদা প্রত্যাহৃত হয়েছে। পাকিস্তানি রপ্তানির ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাকিস্তানের ‘বন্ধু’ বলে পরিচিত কাশ্মীর উপত্যকার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হুরিয়ত কনফারেন্স নেতাদের নিরাপত্তারক্ষীদের তুলে নেওয়া হয়েছে।

তাৎক্ষণিক এসব ব্যবস্থার বাইরের উপায় বলতে রয়েছে অন্য ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা, যাতে পাকিস্তানের টনক নড়ে। আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দুই মুরব্বির একটি যদি হয় চীন, অন্যটি তাহলে সৌদি আরব। দুই দেশের কেউই ভারতের চাহিদা অনুযায়ী পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে রাজি নয়। চীনের কাছে পাকিস্তান ‘শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের অকৃত্রিম বন্ধু’। প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের জন্য সেই বন্ধুকে ত্যাগ করতে তারা নারাজ। সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো। কিন্তু সেই ভালো এতটা ভালো নয়, যা দিয়ে পাকিস্তানকে হামাগুড়ি দেওয়ানো যায়। সৌদি যুবরাজ ভারতে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তৎপর। কিন্তু তাতে চিড়ে ভিজবে কি? চীনা অনাগ্রহে জাতিসংঘও বিষহীন ফণী। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারিতে জাতিসংঘও আগ্রহী হবে না। হলেও চীন ভেটো দেবে। কূটনৈতিক তৎপরতার সীমা ও কার্যকারিতা কতটা ভারতের, তা জানা। এ কথাও জানা, যে দেশটার এত বিরুদ্ধাচরণ, সেই পাকিস্তানও ‘সন্ত্রাসবাদের শিকার’। পাকিস্তানের এই দাবি যতটা সংগত, ততটাই অনস্বীকার্য এই সত্য যে সে দেশের রাষ্ট্রশক্তি সন্ত্রাসবাদীদের মুরব্বি। তাদের চিরন্তন মদদদার।

তাহলে কোন উপায় খোলা থাকছে ভারতের কাছে? একটাই, স্বল্প মেয়াদের সীমিত যুদ্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ট্যাকটিক্যাল স্ট্রাইক। কারগিলের মতো যুদ্ধ করার ঝুঁকি এখন আরও প্রবল। কারণ, সেবারের মতো জমি দখল পাকিস্তান এবার করেনি। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবি বুক বাজিয়ে ভারত জাহির করেছে। তাতে পাকিস্তানের ক্ষতি কতটা হয়েছে, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু ভারত পেল পুলওয়ামা। দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পুরোটা আজ সন্ত্রাসীদের মুক্তাঞ্চল। বেড়েই চলেছে ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গিদের সংখ্যা। গোটা উপত্যকায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ছিটেফোঁটা দৃশ্যমান নয়। এই অবস্থায় আরও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ভোট জিততে সহায়ক হলেও হতে পারে। কিন্তু বাস্তব অবস্থার হেরফের তাতে ঘটবে না। কিছুদিন পর আবার একটা পুলওয়ামা ঘটবে।

পাকিস্তানকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার একমাত্র উপায় যুদ্ধ হলে তা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। বৃহৎ শক্তিরাও দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীকে যুদ্ধ
করতে দেবে না। এই অবস্থায় বিকল্প উপায় একটাই—কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রেখে পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারকে উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য না করে তাদের সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়া। পাশাপাশি প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ নজরদারি তীক্ষ্ণতর করা। সীমান্তপারের জঙ্গি ঘাঁটি নষ্ট করার পাশাপাশি কাশ্মীরি জনতার মন জয়ও জরুরি। তাদের থেকে দেশি সন্ত্রাসীদের বিচ্ছিন্ন করার কাজ কঠিন হলেও তা অবশ্যকর্তব্য। এগুলো ছাড়া দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো পথ দৃশ্যমান নয়।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি