চ্যালেঞ্জের মুখে 'ওসমান সাম্রাজ্য'

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান এত দিন নিজেকে মাদক, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলনের ‘শাহানশাহ’ দাবি করলেও, সম্প্রতি এসব অপরাধে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, মামলায় যাঁদের নাম উঠে এসেছে, তাঁদের অনেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী কিংবা নিকটাত্মীয়।

গত বুধবার নারায়ণগঞ্জে গিয়ে দেখা গেল, পরিবেশ অনেকটাই শান্ত। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা জানান, গত ৪০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম শামীম ওসমানের প্রতি পুলিশ প্রশাসন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তাঁর মুখোশ উন্মোচন করেছে। পুলিশ প্রশাসনের সাম্প্রতিক অভিযানে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সংস্কৃতিসেবীরা সন্তোষ প্রকাশ করলেও ওসমান পরিবার দারুণ ক্ষুব্ধ। তবে এসপির আগের ‘রেকর্ড’ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধির কাছে অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, শামীম ওসমান এবার ধরা খেয়েছেন। তাঁর প্রধান রাজনৈতিক ঘাঁটি নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস ক্লাব। এই ক্লাব পরিচালিত হয় শামীম ওসমানের নির্দেশে। ক্লাবের সম্পাদক বানানো হয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে, যাঁর বাবা একাত্তরে শান্তি কমিটির লোক ছিলেন। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেছেন, শামীম ওসমান সারাক্ষণ বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। অথচ বিএনপি নেতা ও সিটি কাউন্সিলর শওকত হাশেম ওরফে শফী, উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ওরফে মুকুল ওসমান পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নির্বাচনে তাঁদের বিজয়ী হওয়ার পেছনে ওসমান পরিবারের ‘অবদান’ কম নয়। ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনেও কিশোরগঞ্জের একটি আসনে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে শামীম ওসমান প্রশাসনের কাছে ওকালতি করেছিলেন, যিনি তাঁর বন্ধু।

সাম্প্রতিক অভিযান সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সাত খুন মামলার আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, ‘এসপি হারুন অর রশীদের অনেক কাজই আমরা পছন্দ করি না। নির্বাচনের সময় তিনি বিএনপির নেতা-কর্মীদের গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার করিয়েছেন। কিন্তু এখন যদি তিনি সত্যি সত্যি নারায়ণগঞ্জকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করতে অভিযান চালিয়ে থাকেন, আমরা বিরোধিতা করব কেন?’ তবে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘আমরাও চাই নারায়ণগঞ্জ মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত হোক। কিন্তু অভিযানের নামে অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হলে সেটি সমর্থন করতে পারি না।’

নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র এখন এমপি বনাম এসপির ‘লড়াই’ প্রধান আলোচনার বিষয়। অতীতে নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের অবাধ্য হয়ে প্রশাসনের কেউ কিছু করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত নেই। এমনকি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলেও ‘ওসমান সাম্রাজ্য’ অক্ষত ছিল। পুলিশ প্রশাসন বলেছে, নারায়ণগঞ্জের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা ভেবে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বন্ধে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। সন্ত্রাসের জনপদকে শান্তির জনপদ বানাবে। িকন্তু তাদের ভয়, এই অভিযান যৌক্তিক পরিণতি পাবে কি না। ইতিমধ্যে ওসমান পরিবার এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি পুলিশ প্রশাসন পুরো পরিস্থিতি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে চিঠি দিয়েছে, যাতে কোথায়, কোন তারিখে কোন অভিযানে কারা ধরা পড়েছেন, কারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তার বিবরণ আছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান সমর্থন করলেও সাংসদ শামীম ওসমান প্রশাসনের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন। পুলিশ প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে ১৬ দফা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে, যার প্রথম দফায় বলা হয়, তিনি অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে এবং ওসিদের বদলির হুমকি দিয়ে আইভীপন্থী নিরীহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন। এসব আসামিকে গ্রেপ্তার করিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় দফা অভিযোগে বলা হয়, নির্বাচনের আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নির্বাচনী সভায় আসতে শামীম ওসমানের অনুসারীরা বাধা দেন। পরে পুলিশ তাঁর আসা-যাওয়ার পথ করে দিলে সর্ব মহলে তাদের ভূমিকা প্রশংসিত হলেও ওই সাংসদ ক্ষুব্ধ হন।

তৃতীয় দফায় আছে, শামীম ওসমানের দেহরক্ষী মিজান ফকির বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে পুলিশের তথ্য ফাঁস করে দিলে তাঁর কাছ থেকে সেই যন্ত্র ফেরত নেওয়া হয়। দেহরক্ষী সাংসদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত হলেও সাংসদপুত্র অয়নকেও নিরাপত্তা দিতেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে অস্ত্রসহ কক্সবাজারে যান, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এরপর ওই দেহরক্ষীকে অন্যত্র বদলি করা হয়।

চতুর্থ দফায় বলা হয়, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ২১ মামলার আসামি মীর হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এলেও ক্ষুব্ধ হন সাংসদ। এ ছাড়া ভূমিদস্যু, মাদক কারবারিদের ছাড়িয়ে নিতে শামীম ওসমান তদবির করেছেন এবং হুমকি দিয়েছেন বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অভিযোগে জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহ আলম গাজী ওরফে টেনু গাজীকে গ্রেপ্তার করায় সাংসদ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের ৫ নম্বর ঘাটসংলগ্ন এলাকায় ৪১ জন জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই জুয়াড়িদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জনৈক রাজুর নাম এসেছে, যিনি শামীম ওসমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফতুল্লা বালুর ঘাটে জনৈক ইকবাল হোসেন চৌধুরীর গোডাউন থেকে তেল চুরির সময় তিন তেল চোরকে গ্রেপ্তার করায়ও সাংসদ ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

পুলিশ প্রশাসনের অপর এক অভিযোগে বলা হয়, জনৈক আজিজুল গাফফার খান শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের সম্বন্ধী ভিকিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মামলা করেছেন। এ ঘটনায় একজন গ্রেপ্তার হলেও ভিকি পলাতক। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ পুলিশ মেরি এন্ডারসনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও ৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, এই ব্যবসায় শামীম ওসমানের শ্যালক টিটু জড়িত।

৬ এপ্রিল দলীয় ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে শামীম ওসমান এসপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যেই টের পাইবেন।...শাহ নিজামের বিরুদ্ধে জিডি করবেন, টিটুর বিরুদ্ধে মদ সাপ্লাইয়ের মামলা দিয়েছেন বলে মনে করছেন আমরা ভয় পেয়ে গেছি। ভয় পাবে কে? যে খারাপ লোক সে। এগুলো করে আমাকে কাবু করতে পারবেন না।’

অন্যদিকে এসপি হারুন অর রশীদ গত বুধবার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বলেছেন, ‘সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, তেল চোর ও মাদকবিরোধী অভিযান চালালেই যদি আপনাদের লোক ধরা পড়ে, আমাদের কিছু করার নেই। অপরাধী যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তাকে শাস্তি পেতে হবে।’ ওই বৈঠকে শামীম ওসমানের ছোট ভাই ও জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম ওসমান ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন।

সাংসদ শামীম ওসমানের সঙ্গে কী সমস্যা হয়েছে জানতে চাইলে এসপি হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কোনো সাংসদের সঙ্গেই আমার সমস্যা নেই। সরকারের নীতি হলো, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আমরা সেটাই পালন করছি। কিন্তু মাদক ও সন্ত্রাসীদের ধরলেই দেখা যায় প্রভাবশালী কারও না কারও লোক ধরা পড়ে।’

স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা আরও জানান, নারায়ণগঞ্জে শত শত শিল্পকারখানা আছে এবং সাতটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। তাই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড অনেক বেড়ে গেছে। এসবকে পুঁজি করে যঁারা তৈরি পোশাকশিল্প, ঝুট ব্যবসা, পরিবহন, ট্রাকস্ট্যান্ড ও ফুটপাতে হকার বসানোর নামে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করতেন, পুলিশের সাম্প্রতিক অভিযান কিছুটা হলেও তঁাদের ধাক্কা দিয়েছে।

আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটি আপসের খেলাও হতে পারে। কেননা, নির্বাচনের আগে পুলিশ প্রশাসন ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে একটিও কথা বলেনি। তাদের নির্দেশমতোই সব কাজ করেছে। এখন হঠাৎ বিদ্রোহী হওয়ার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]