ব্যক্তিস্বার্থ বনাম প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি

শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে এবং আইনের শাসন ও মানবমুক্তির লক্ষ্যে ইন্টারনাল ভিজিল্যান্স বা অবিরাম সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। সেই সতর্ক দৃষ্টি থাকতে হবে বিভিন্ন দিকের। সরকারি দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একাধিপত্য প্রতিরোধ করতে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সংবিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় সংস্থা কাজ করে। প্রজাতন্ত্রের সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকাও অপরিহার্য। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানেরা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীর মতোই কর্মচারী। তাঁরা শপথ না নিলেও তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব অন্যান্য সাধারণ কর্মচারীর চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী উপযুক্ত শাস্তি তাঁদের প্রাপ্য।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে অসামরিক পদে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি...কোন কর্তৃপক্ষ দ্বারা বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত’ হতে পারবেন না। ‘তাঁহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত’। তবে এই বিধান সরকারি কর্মচারীদের ‘সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য’ হবে না, যেখানে ‘কোন ব্যক্তি যে আচরণের ফলে ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হইয়াছেন, সেই আচরণের জন্য তাঁহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা হইয়াছে; অথবা...রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে উক্ত ব্যক্তিকে অনুরূপ সুযোগদান সমীচীন নহে।’

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা এবং সমাজে ফৌজদারি অপরাধ দমনে পুলিশ বাহিনী দুই শ বছর যাবৎ ভূমিকা
পালন করছে। ফৌজদারি অপরাধীদের নিয়ে তাদের কাজ, একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তা ব্রিটিশ আমলেও ঘুষ খেয়েছেন। তখন কঠিন ও নিরপেক্ষ বিদেশি শাসন ছিল, স্বজনপ্রীতির লেশমাত্র ছিল না, তাই দুর্নীতি ধরা পড়লে বা কর্তব্যে গাফিলতি থাকলে চাকরিচ্যুত হয়েছেন।

যিনি যে পদেই থাকুন না কেন, একজন কর্মকর্তা একজন ব্যক্তি। তিনি কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসামুক্ত নন। কেউ যদি তাঁর স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করেন বা মারধর করেন, যেকোনো অপরাধীর মতোই শাস্তি তাঁর প্রাপ্য। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমল পর্যন্ত সমাজ এমন ছিল যে কোনো অপরাধীর পাশেই তাঁর সহকর্মীরা বা সমাজের কেউ দাঁড়াত না। আইন স্বাভাবিকভাবে তার নিজস্ব গতিতে চলত।

পুলিশ বা কোনো বিভাগেরই সব কর্মকর্তা দুর্নীতি করেন না। অনেকে করলেও বেশির ভাগই করেন না, কেউ কেউ খুব বেশি করেন। তাঁরা দুর্নীতি করে বিত্তের পাহাড় নয়, পর্বতসমান সম্পদ করেন। অধিকাংশই ধরা পড়েন না; অল্পসংখ্যকের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়েন। কেউ শাস্তিও পান।

যত বদনামই থাকুক, এখনো পুলিশ বাহিনীতে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা রয়েছেন অনেকে। অনেকে মানুষ হিসেবে সজ্জন ও সংস্কৃতিমান। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, পুলিশের অনেক জে্যষ্ঠ কর্মকর্তা অবসর সময়ে বড় বড় বইয়ের দোকানে যান এবং বেছে বেছে ভালো ভালো বই কেনেন। যাঁরা বইপত্র পড়েন, অনৈতিক কাজে তাঁদের মন সায় দেবে না। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সব সৎ কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাজনীতি ও সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে, শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই ফেরেশতাতুল্য থাকবেন, এমনটি ভাবা ঠিক হবে না।

পুলিশ বাহিনীর মতোই রাষ্ট্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবিধিবদ্ধ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পুলিশের কাজ অপরাধ দমন, দুদকের কাজ দুর্নীতি দমন। পুলিশের একজন ডিআইজি পর্যায়ের কর্মকর্তা নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন। দুর্নীতিতেও অভিযুক্ত হয়েছেন। দুদক তাঁর অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। তাঁর আয়বহির্ভূত সম্পদের তদন্ত করছিল দুদক। গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে জানা যায়, অভিযোগ থেকে বাঁচতে তিনি দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে ২৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা ও দুদক কর্মকর্তার টেলিফোনালাপ প্রকাশ পেয়েছে। দুদক কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলেছেন, ফোনের ওই কণ্ঠ তাঁর নয়। তবে তাঁর হোক বা না হোক, ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ নয়, ‘তথ্য ফাঁসে’র অভিযোগে দুদক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এই দুই কর্মকর্তার অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অতিগুরুতর বিষয়। উপাখ্যানটির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চায় জনগণ। কোনো কারণে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা হলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি শুধু নয়, বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্য ক্ষেত্রে সরকারের যে অর্জন, তা হবে ম্লান।

কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে দোষী বলা যায় না। এ ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ‘প্রাক্‌-যোগ্যতা নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি’-এর অভিযোগ এনেছিল। সেই অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক সারা দুনিয়া তোলপাড় করে। তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে তাতে জড়ানো হয়। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ-বিদেশের আদালতে বিচার-সালিস ও তদন্তের পর শেষ পর্যন্ত কানাডায় সেই মামলা আর চলেনি। অনেক পানি ঘোলার পর এ বছর ২২ জানুয়ারি ‘প্রাপ্ত তথ্য ও রেকর্ডপত্রের আলোকে প্রমাণিত হয়নি বিধায় তা দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক পরিসমাপ্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে’।

এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, কেউ যদি অপরাধ না করেন, তাহলে তাঁর ভয় কী? তথ্য–প্রমাণ দিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করাই উত্তম উপায়। ঘোর-প্যাঁচের পথে অথবা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা অথবা কেউ কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করা নির্বুদ্ধিতা বা হঠকারিতা মাত্র।

দুর্নীতি কোথায় নেই? বিভিন্ন দেশের সরকারের দুর্নীতির দুর্নাম আছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের
দুর্নীতি যে কী পরিমাণ, তার পরিচয় পেয়েছি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ থেকে। ইউরোপের একটি বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত ওই বইয়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির যে ফাইল, পাশাপাশি সাজালে তার ‘দৈর্ঘ্য হবে ১৫ কিলোমিটার’।

দুর্নীতি ছাড়াও অন্যান্য অপরাধেও সরকারি কর্মকর্তারা অভিযুক্ত হতে পারেন। অপরাধ করে ব্যক্তি—সমস্ত প্রতিষ্ঠান নয়। ব্যক্তিস্বার্থ আর প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি এক জিনিস নয়। যার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, তার দায় তারই—প্রতিষ্ঠানের নয়। যে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুলে অথবা দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অনেকে অপরাধ না করেও বছরের পর বছর জেল খাটে, সেখানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও যখন কেউ সরকারের আনুকূল্য পান, তখন মানুষ হতাশ শুধু নয়, ক্ষুব্ধ হয়। কোনো থানার ওসির অপরাধের দায় দেশের সব ওসির ওপর বর্তায় না, পুলিশ বিভাগই-বা নেবে কেন?

ডিআইজি-দুদক কর্মকর্তা উপাখ্যান এবং ডিজিটাল অপরাধ আইনে অভিযুক্ত সোনাগাজীর সাবেক ওসির বিষয়টি সরকারের জন্য মোটেই বিব্রতকর নয়, বরং সরকারের জন্য একটি পরীক্ষা। সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে আন্তরিক, তা এই তিন কর্মকর্তার প্রতি প্রশাসনের আচরণ থেকে প্রমাণিত হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক