ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যই যেখানে বেশি

দেশের উন্নয়নের সঠিক নীতির চেয়ে রাজনৈতিক ঐক্য বেশি জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিক-সমাজতাত্ত্বিক নওমি হোসেন। দ্য এইড ল্যাব: আউটস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ’স আনএক্সপেকটেড সাকসেস বইয়ে তিনি এ কথা বলেছেন। কথার সপক্ষে অনেক নজিরও তিনি দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ যে আজ মাতৃমৃত্যু হ্রাস, শিশুমৃত্যু হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে প্রভূত উন্নতি করেছে, তার পেছনে আছে রাজনৈতিক মতৈক্য। সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে যে ১ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করছে, তাদের মধ্যে ৫৬ লাখই মেয়ে। ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের সূত্র দিয়ে প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। যে দেশে একসময় নারীশিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হতো, সেই দেশে এমন তথ্য সত্যিই চমকপ্রদ।

মূলত সরকার ও দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত দুটি প্রকল্প এ দেশে এই নীরব পরিবর্তন এনেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম বিএনপি সরকার উপবৃত্তি চালু করে। এতে যেমন মানুষ মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রণোদনা পেয়েছে, তেমনি সরকারি-বেসরকারি নানা প্রচারণায় মানুষের মধ্যে সচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রসঙ্গ ঠিক এখানেই চলে আসে। কারণ, ১৯৯১ সালের প্রথম বিএনপি সরকার উপবৃত্তি চালু করার পর প্রতিটি সরকারই তা চালিয়ে গেছে। উপবৃত্তি প্রথমে শুধু মেয়েদের দেওয়া হতো, পরে তাতে ছেলেদেরও যুক্ত করা হয়। অথচ বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, এক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আগের সরকারের অনেক প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। দুই প্রধান দলে শীর্ষ নেতা নারী হওয়ায় নারীশিক্ষার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। সে জন্যই এই সফলতা।

এত দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিরোধ ও দুর্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে এতটা উন্নতি করেছে, অর্থনীতিবিদেরা তাকে প্যারাডক্স বা আপাত-স্ববিরোধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে এই উন্নয়নের কেন্দ্রে আছে বিভিন্ন ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর অভিন্ন চিন্তা বা ঐকমত্য। নওমি হোসেন বলছেন, ১৯৭০ সালের সাইক্লোন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও ১৯৭৪ সালের বন্যার ত্রিমুখী আক্রমণ শাসকগোষ্ঠীসহ সবার চিন্তায় পরিবর্তন নিয়ে আসে। এরপরই মূলত গরিবমুখী সরকারি উদ্যোগ গৃহীত হয়। তার ফল হিসেবে দেখা যায়, বিপর্যয় মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন যথেষ্ট প্রস্তুত। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ধারাবাহিক বিনিয়োগও সে কারণে।

প্রথমত, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর শাসকশ্রেণি বুঝতে পারল, মৌলিক সামাজিক সুরক্ষা ও মানব উন্নয়নের ওপর তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। সে জন্য দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিল। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায় এই মানুষদের সমর্থন আদায়ে শাসকশ্রেণি এদের মৌলিক সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়। তৃতীয়ত, সব দলই বাজার ও গরিবমুখী অর্থনীতি ও মানব উন্নয়নধর্মী কৌশল গ্রহণ করে। বিবদমান দলগুলো বুঝতে পারে, উন্নয়নের ওপরই তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে সংস্কৃতি, আদর্শ, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া—সবই বিসর্জন দেওয়া যায়। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ন্যূনতম এটুকু ঐকমত্য হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নীতির ধারাবাহিকতা থাকার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। এর ঠিক বিপরীত চিত্রও আছে। সমাজতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশকে ‘দুর্বল রাষ্ট্র’ ও ‘সবল সমাজ’ হিসেবে আখ্যা দেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, বিভিন্ন সরকার প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা পুনর্গঠন, যৌতুক বন্ধ ও খাসজমি বিতরণের চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই পুরোপুরি সফল হয়নি। সমাজের শক্তিশালী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোয় ন্যূনতম আঁচড় লাগতে দেয়নি। আঁতে ঘা লাগলে এরা হরতাল ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিতে পারে। বিভিন্ন বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বাররক্ষকের ভূমিকায় আমাদের রাষ্ট্র যা-ও কিছুটা সফল, জাতি হিসেবে এখনো আমরা শতধাবিভক্ত। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, আমলাতন্ত্র এখন নিজেদের স্বার্থে হলেও যতটা এককাট্টা হয়েছে, জাতি হিসেবে আমরা তার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। জাতিগত ঐক্য নেই বলেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐকমত্য নেই। আমাদের মধ্যে যে ঐক্য আছে, তা মূলত স্বার্থের ঐক্য। উল্লিখিত বিষয়ে ঐকমত্যও মূলত স্বার্থের। অর্থাৎ টিকে থাকার স্বার্থ। তবে এর সঙ্গে মানবিকতার যে ন্যূনতম যোগ নেই, তা বলা যাবে না।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় অর্জন হিসেবে অনেক বড় হলেও স্বাধীনতার পর সেই দলের ঐক্য খানখান হয়ে ভেঙে পড়তেও সময় লাগেনি। কারণ, সম্পদ ছিল সীমিত, সেই সীমিত সম্পদের ভাগ নিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি বইয়ে ডেভিড লুইস বলেছেন, এ কারণেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এত দলাদলি, যার ভিত্তি হচ্ছে সুবিধাপ্রাপ্তি। তাই এখানে শক্তিশালী শ্রেণিগত ঐক্য সেভাবে দেখা যায় না, যা উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গায় দেখা যায়। একসময়ের ভূস্বামী শ্রেণির মধ্যে বা আজকের পুঁজিপতি কোনো শ্রেণির মধ্যেই ঐক্য দেখা যায় না, তাই দলবদলও এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। রাজনৈতিক স্বার্থ ও শ্রেণিগত স্বার্থ এখানে জড়াজড়ি করে আছে। দেশের গ্রামাঞ্চলে যে প্রকৃতপক্ষে আদর্শভিত্তিক বা সহমর্মিতাভিত্তিক আন্দোলন নেই, তার কারণ হিসেবে লুইস বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এমনকি উপনিবেশের যুগে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মতো যেসব আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার ব্যাপকতাও তেমন একটা ছিল না। লুইস বলছেন, এসব আন্দোলনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীভিত্তিক ছিল।

ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যের পরিসর বড় হলে যা হয়, আমাদের তা-ই হয়েছে। জাতি ও রাষ্ট্রগঠনে যে বড় বড় সংস্কার দরকার, তা আমরা করতে পারিনি বলে কিছু সূচকে উন্নতি সত্ত্বেও আজ জাতি হিসেবে আমরা শতধাবিভক্ত। সমাজে সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই বললেই চলে। আর দুর্নীতির তো শেষ নেই। সম্ভবত, এসব বিষয়েই আমাদের মতৈক্য হয়েছে।

প্রতীক বর্ধন: প্রথম আলোর সহসম্পাদক
[email protected]