সাঁওতালদের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি

যেসব রাষ্ট্র আইনের শাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, সেখানে কোনো মানুষ অপরাধের শিকার হয়ে যখন ন্যায়বিচারের দাবিতে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়, তখন সেই সংক্ষুব্ধ মানুষটির অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়াই নিয়ম। কিন্তু এর গুরুতর ব্যত্যয়ের খবর এল গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। এই নিপীড়িত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যরা প্রায় আড়াই বছর আগে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের পরিকল্পিত নির্যাতনের শিকার হয়ে ন্যায়বিচারের আশায় মামলা করেছিলেন। দীর্ঘ সময় পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন সেই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করলে সাঁওতালেরা জানতে পারলেন, অভিযোগপত্র থেকে প্রধান আসামিসহ গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নামই বাদ দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে তাঁরা গত রোববার মিছিল-সমাবেশ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৬২ সালে রংপুর সুগার মিলের জন্য প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে ১৮টি গ্রামের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষকে তাদের জমি ও বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তাঁরা এ অন্যায় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন অন্তত একটা যুক্তিতে যে, তাঁদের অধিগ্রহণকৃত জমিতে রংপুর সুগার মিলে সরবরাহের জন্য আখ চাষ করা হবে; ভূমি অধিগ্রহণের প্রধান শর্তই ছিল এই যে সেসব জমি আখ চাষ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে সুগার মিল কর্তৃপক্ষ সেসব জমিতে আখ চাষ না করে ধান ও তামাক চাষের জন্য অন্যদের লিজ দেয়। ফলে তাঁদের পক্ষে এই যুক্তি প্রবল হয়ে ওঠে যে, তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ফিরে পাবেন।

কিন্তু অধিকারবঞ্চিত এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কোনো ন্যায্য অধিকারই কখনো সুরক্ষিত হয়নি। তাই তাঁদের কিছু অংশ ২০১৬ সালে ওই সব অধিকৃত জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন। কিন্তু তাঁদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয় অত্যন্ত নিষ্ঠুর পন্থায়। রাতের অন্ধকারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের ঘরবাড়িতে, ফলে সংঘর্ষ বাধে এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তিনজন সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সে সময় এই ঘটনায় দেশে-বিদেশে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছিল; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাঁওতালদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার যেসব ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা দেখা গিয়েছিল। 

সেসব অপরাধের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ নেই। মামলার প্রধান আসামি একজন সাবেক সাংসদ এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা। পুলিশের তিন সদস্যের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। অভিযোগপত্র থেকে তাঁদের বাদ দেওয়ার ফলে এই অভিযোগপত্র কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন যুক্তিসংগতভাবেই অভিযোগপত্রটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন প্রধান আসামিদের যুক্ত করে নতুন অভিযোগপত্র তৈরি করা পুলিশের দায়িত্ব। সাঁওতালদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।