ভারতীয় গণতন্ত্রের সবটুকু শেষ হয়ে যায়নি: অমর্ত্য সেন

>৬ অক্টোবর ২০১৯ যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্কার সাময়িকীতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-এর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ‘ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে অমর্ত্য সেনের আশা ও শঙ্কা’ শিরোনামের সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদের দ্বিতীয় অংশ আজ প্রকাশিত হলো।
আইজাক চটিনার
আইজাক চটিনার

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য নিউইয়র্কার-এর স্টাফ রাইটার আইজাক চটিনার

আইজাক চটিনার: মোদির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ আছে—এই কথা বলা, আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ আছে—এই কথা বলার মধ্যে কি কোনো টানাপোড়েন আছে?

অমর্ত্য সেন: জনগণের মধ্যে যদি ভীতি কাজ না করত, তাহলে আরও বেশি থাকত।

আইজাক চটিনার: কিন্তু জনগণ যদি ভয় পেয়েই থাকে, তাহলে তো প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় গণতন্ত্র আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, আমরা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সম্পর্কে আগে যা ভাবতাম, এখন আর সেভাবে ভাবা চলে না। নাকি আপনি তা মনে করেন না?

অমর্ত্য সেন: আমি তা মনে করি। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের সবটুকু শেষ হয়ে যায়নি। প্রথমত, ভারতে এমন কিছু সাহসী সংবাদপত্র আছে, যারা কিছু প্রকাশের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে না। সে রকম দু-একটা টিভি স্টেশন আছে, রেডিও স্টেশন আছে, জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত একটা ফেডারেল রাষ্ট্রও বটে। কয়েকটি রাজ্য আছে, যেখানে বিজেপি একমাত্র প্রধান শক্তি নয়।

আইজাক চটিনার: পশ্চিমবঙ্গসহ।

অমর্ত্য সেন: তামিলনাড়ু ও কেরালাতেও নয়। আরও কয়েকটি অঞ্চল আছে, যেখানে বিজেপির একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আপত্তি আছে। একইভাবে আছেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের ওপর আমার গভীর আস্থা আছে, কিন্তু কাজ করছেন খুব মন্থরভাবে; কিছু বিচারক আছেন, যাঁরা সরকারের অভিপ্রায়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতে বেশি আগ্রহী। সুতরাং, ভারতে নানান গণতান্ত্রিক উপাদান রয়ে গেছে। অন্যদিকে, আমরা যদি দেখি, গত ১৫ বা ৩০ বছরে কি গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। আমি বলব, হ্যাঁ, ঘটেছে। ১৯৭০–এর দশকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন জরুরি অবস্থা জারি করেন, তখন গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি সাধারণ নির্বাচনে গিয়েছিলেন এবং আমরা যেমন ভেবেছিলাম যে বিরোধী দলগুলো ভয়ভীতি ও বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হবে, সে রকম কিছু ঘটেনি এবং ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে হেরেছেন। তাই আমার মনে হয়, প্রতিরোধের কিছু উপাদান আছে, সেগুলো আরও শক্তিশালী হতে পারে। একটা গোষ্ঠী আছে, যাদের বলা হয় নকশাল, তাদেরকে মাওবাদী চরমপন্থী মনে করা হয়। কিছু লোক আছে, যাদেরকে নকশালপন্থী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। সুতরাং ভারতের রাজনৈতিক চিত্রটা মিশ্র। তবে আমরা যে উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক চিত্রটা সহজেই পেতে পারতাম, যা কিছু মাত্রায় অতীতে ছিল, এখন সে রকম নয়।

আইজাক চটিনার: নির্বাচনের পর আপনি লিখেছিলেন, ‘অনেকে হয়তো বলতে চাইবেন, বিজেপি কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে “ভাবাদর্শের লড়াইয়ে” জিতেছে। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের দর্শনের বিজয় ঘটেনি, আর গান্ধী, নেহরু ও রবীন্দ্রনাথ যে সবর্জনের অংশগ্রহণভিত্তিক ঐক্যের ভাবধারার কথা বলতেন, তারও কোনো লক্ষণীয় অবক্ষয় ঘটেনি।’ আপনি কি ব্যাখ্যা করবেন, কী বোঝাতে চেয়েছেন, এবং সেটাই ভাবেন কি না?

অমর্ত্য সেন: আমি এখনো সেভাবেই ভাবি। কাশ্মীর বা এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণকে উত্তেজিত করে তোলা খুবই সহজ। ভারতীয় শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাশ্মীর যে বিশেষ অধিকার ভোগ করে আসছিল, সেটা অব্যাহত না থাকার কোনো কারণই নেই। কিন্তু এর বিরুদ্ধে জনগণের সমর্থন বাড়ানো সহজ। সাধারণ নির্বাচনে সেটাই করা হয়েছে; ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে মিসেস থ্যাচারের পক্ষে যেটা করে হয়েছে, ভারতের সাধারণ নির্বাচনেও মোদির পক্ষে সমর্থন বাড়াতে কাশ্মীর ইস্যুকেও সেভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। আপনার হয়তো মনে আছে, মিসেস থ্যাচার নির্বাচনে হেরে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আসে ফকল্যান্ড যুদ্ধ।

আইজাক চটিনার: আমার জন্ম সেই বছরই, সুতরাং আমার মনে নেই। তবে হ্যাঁ, ‘ফকল্যান্ড ফ্যাক্টর’ কথাটা জানি।

অমর্ত্য সেন: ফকল্যান্ড যুদ্ধ ব্রিটিশদের মধ্যে পরিবর্তন এনেছিল, তারা জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিল। যদিও সেটা খুব বেশি দিন থাকেনি, তবু যত দিন ছিল, মিসেস থ্যাচারের বিপুল বিজয়ের জন্য সেটাই যথেষ্ট ছিল। এ বছর আরও আগের দিকে ভারতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দিকে যদি তাকান, দেখবেন, তাতে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছিল। প্রবল প্রচারণা, ভীতি; ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যা চলছিল। ভারত সরকার দাবি করেছিল, পাকিস্তান ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা কনভয়ের ওপর নাশকতা করিয়েছে। যুদ্ধের চেয়েও বেশি খারাপ ছিল যুদ্ধ নিয়ে উন্মাদনা। এটা একটা প্রমাণ যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, কিন্তু আসলে ততটা জনপ্রিয় হয়নি, নির্বাচনের ফলাফল থেকে যতটা মনে হয়। ভারতের গ্রামাঞ্চলে যখনই দেখার চেষ্টা করা হয়েছে যে সংখ্যালঘুদের একদম গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় কি না, তখনই দেখা গেছে সেটা করার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা নেই। সংখ্যালঘুদের প্রতি একধরনের সহিষ্ণুতা আছে, এটা একটা প্রবল ঐতিহ্য, আজও এটা আছে।

আইজাক চটিনার: ভারত এমন কাউকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেনি, যিনি সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক জাতিগত সহিংসতায় নেতৃত্ব দেননি।

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ, এটা সত্য। মোদির একটা বড় সাফল্য হলো, তাঁর বিরুদ্ধে ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে ২০০২ সালে গুজরাট হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে করা মামলা আদালতকে দিয়ে খারিজ করাতে পেরেছেন। তাই ভারতের অনেক মানুষ এটা বিশ্বাস করে না। [২০০২ সালে মোদি গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পরেই মুসলমানবিরোধী দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই দাঙ্গা রোধে ব্যর্থ হওয়া এবং দাঙ্গায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে মোদির বিরুদ্ধে মামলা হলে, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সে দেশে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।]

আমার মনে হচ্ছে, আপনি যদি বলতে চান যে ভারতে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার বিজয় ঘটেছে, তাহলে তো প্রত্যেক মানুষের সত্য জানার সুযোগ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। গণপরিসরে ব্যাপক আলোচনার সুযোগ, সংবাদপত্রের আরও স্বাধীনতা, টেলিভিশনের আরও স্বাধীনতা ভোগ করার কথা; কারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভয় থাকত না। তাই আমি বলব না যে হিন্দুত্ববাদের জয় হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর ভয়ভীতি, সরকারি সেন্সরশিপ ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জুলুম যদি না থাকত এবং মোদি নির্বাচনে জিততেন, তাহলে আমি বলতাম যে হিন্দুত্ববাদের জয় হয়েছে।

আইজাক চটিনার: আমার মনে হয়, আরএসএস ভারতকে ভাবাদর্শগত বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘ সময় ধরে পোষণ করে আসছে।

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ। তারা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে পেরেছে, যা বেশ কার্যকর: ‘ভারত দীর্ঘ সময় ধরে মুসলমান দখলদারদের অধীন ছিল, এখন আমাদের সময় এসেছে, তাদের চিরতরে ধ্বংস করতে হবে। আর যেহেতু দেশের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু, তাই সেটারই প্রতিফলন ঘটাতে হবে।’ কিন্তু আরএসএস লক্ষ করে না যে হিন্দু ইতিহাসে বিভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অনেক সহিষ্ণুতা ছিল। তর্কপ্রিয় ভারত নামে আমার একটি বই আছে, সেখানে আলোচনা করেছি, কত ব্যাপক তর্কবিতর্ক ছিল। আরএসএস একটা ভাবাদর্শ তৈরি করে নিয়েছে, তারা সেটার প্রচার করে চলেছে এবং সেটা ভীষণ কার্যকর হয়ে উঠেছে। এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়; কিন্তু আমি মনে করি দুঃখের বিষয়টাকে বেশি বড় করে দেখানো ভুল হবে। কারণ, পরিস্থিতি এখনো আমাদের হাতেই আছে। আমি যখন ব্রিটিশ ভারতে বেড়ে উঠছিলাম, তখন ব্রিটিশরা গান্ধীর মতো ভারতীয়দের চেয়ে শোচনীয়ভাবে শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই লড়াইয়ে ভারতীয়দের বিজয় সম্ভব হয়েছে।

আইজাক চটিনার: গত মাসে কাশ্মীর পরিস্থিতির দৃশ্যমান অবনতি ঘটেছে। কিন্তু কাশ্মীর এমন একটা জায়গা, যেখানে দেশভাগের সময় থেকেই পরিস্থিতি খারাপ ছিল, বিশেষত ৩০ বছর ধরে। আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক ধরে কাশ্মীরের ব্যাপারে কথা বলায় ভারতের উদারপন্থী নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতা রয়েছে?

অমর্ত্য সেন: অবশ্যই অংশত ব্যর্থ হয়েছেন। কাশ্মীরকে যতটা না ভারতের অংশ মনে হতো, তার চেয়ে বেশি মনে হতো ভারতশাসিত একটা অঞ্চল। তবে সেটা স্বীকার করার পরে, ভারতীয়রা প্রায়ই কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী অংশগুলোর ওপর বড় বেশি শাস্তিমূলক পাল্টা-আঘাত হেনেছে, কখনো কখনো পাকিস্তানপন্থীদের চেয়েও বেশি। পাকিস্তানপন্থীরা ভারতীয়দের দ্বারা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি। কারণ, পাকিস্তানপন্থীরা পাকিস্তানি কাশ্মীরে পালিয়ে যেতে পেরেছে, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই; তাই তাদের ধ্বংস করা অপেক্ষাকৃত সহজ। এইভাবে ভারতবিরোধী আন্দোলন যতটা না কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পাকিস্তানপন্থী হয়ে উঠেছে।
এইভাবে, আগের সরকারগুলোও সব ধরনের রাজনৈতিক ভুলই করেছে। আর আপনি ঠিকই বলেছেন, ভারতের অধিকাংশ মানুষ, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষদেরও বড় অংশ, কাশ্মীরের বিষয়ে নিজেদের জড়াতে অনাগ্রহী থেকেছে বলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয়, এই ভুল অনেক আগেই শোধরানো উচিত ছিল।

আইজাক চটিনার: কাশ্মীরের ব্যাপারে আপনি নিজে কি আরও বেশি কিছু করতেন?

অমর্ত্য সেন: সম্ভবত। কিন্তু আমার হাতে অনেক কাজ ছিল। মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত; তা ছাড়া, কাশ্মীরের বিষয়টা ঠিকভাবে বোঝা প্রায়ই কঠিন, বিশেষত এই কারণে যে তারা একেবারেই একটা বিচ্ছিন্নকৃত জনগোষ্ঠী। আর লোকজন বলেই চলেছে যে পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। এটা একটা ভুল। আমিও ভাবি, কাশ্মীর নিয়ে কি আমার আরও বেশি লেখালেখি করা উচিত ছিল? সম্ভবত হ্যাঁ। আমার মনে হয়, এর উত্তর হ্যাঁ। কিন্তু কেন লিখিনি, তার কোনো ব্যাখ্যা কি আমি দিতে পারি? পারি। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং আরও অনেক বিষয়ে আমার হাতে ছিল প্রচুর কাজ।

আইজাক চটিনার: দ্য গেটস ফাউন্ডেশন ঘোষণা দিয়েছে, তারা মোদিকে পুরস্কার দিতে যাচ্ছে। মোদিকে এখনো আন্তর্জাতিক পরিসরে একজন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে কি আপনি বিস্মিত?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ। মনে হয় বিশ্ব সম্প্রদায় সাফল্য পছন্দ করে, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটসও সাফল্য পছন্দ করেন। আর মোদি এতই ক্ষমতাধর যে তাঁকে একধরনের সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। অকপটেই বলছি, মোদিকে গেটস পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, এই খবরে আমি বিস্মিত হয়েছি, আঘাত পেয়েছি।

আইজাক চটিনার: আপনি দুর্ভিক্ষ নিয়ে অনেক লিখেছেন; দুর্ভিক্ষ রোধের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের গুরুত্ব, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন। আপনি যখন দেখতে পাচ্ছেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে কিংবা কম সাড়া দিচ্ছে, সে রকম কোনো গণতান্ত্রিক দেশ অগণতান্ত্রিক শক্তির দখলে চলে গেছে, তখন কি দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি বিষয়ে আপনি যে কাজগুলো করেছেন, সেসব সম্পর্কে আপনাকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হচ্ছে?

অমর্ত্য সেন: না। আমি এখনো মনে করি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে। নিয়মিত অপুষ্টি, নারীর প্রতি নিয়মিত বৈষম্য ইত্যাদি অদৃশ্যভাবে বিস্ফোরক কদর্যতা প্রতিরোধে গণতন্ত্র খুব একটা সফল হয় না। সেই লক্ষ্যে গণতন্ত্রকে অবশ্য কাজে লাগানো যেতে পারে, কিন্তু সেটা নির্ভর করে রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর। গণতন্ত্র কোনো সমস্যার স্বয়ংক্রিয় সমাধান নয়। গণতন্ত্র ম্যালেরিয়া সারানোর কুইনাইনের মতো নয়। গণতন্ত্র সামর্থ্য সৃষ্টি করার একটা পন্থা। সামর্থ্যপূর্ণ পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকলে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা খুব সহজ হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের একদম শেষ পর্যায়ে ব্রিটিশ ভারতে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, কিন্তু যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল এবং পরপর কয়েকটা নির্বাচন হলো, তখন দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে গেল। দুর্ভিক্ষের কদর্যতার রাজনীতিকরণ খুবই সহজ ছিল। কিন্তু নিয়মিত অপুষ্টি, পুরুষের তুলনায় নারীর নিয়মিত বঞ্চনা, শিশুদের পড়াশোনার অব্যাহত দুর্দশা—এই বিষয়গুলোর রাজনীতিকরণ করা খুব কঠিন। আমি জানি না, গণতন্ত্র শব্দটা খুব বেশি ব্যবহার করি কি না। কিন্তু এটা সত্য যে কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র একটা সহজ সমাধান। অন্যগুলোর সমাধান আরও কঠিন।

আইজাক চটিনার: বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্ক আপনাকে যতটা হতাশ দেখতে পাব বলে আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ততটা হতাশ দেখাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনি সাধারণভাবে সবকিছু নিয়েই বেশ আশাবাদী একজন মানুষ।

অমর্ত্য সেন: আশাবাদী বলব না। তবে আমি যতটা নিরাশ প্রকৃতির হব বলে আশা করা হয়, কখনো কখনো আমি তার চেয়ে কম নিরাশ। [হাসি] 

আইজাক চটিনার: কেন আপনার মনে হয়, আপনাকে নিরাশ প্রকৃতির ভাবা হয়? আর কেন মনে করেন, আপনি সে রকম নন?

অমর্ত্য সেন: কারণ, শৈশবে আমি এমন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, যখন সবকিছুই বেশ খারাপ ছিল। আমি যখন বেড়ে উঠছিলাম, তখন আমার সব কাকা-মামাকে প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন দিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাঁরা কখন মুক্তি পাবেন, তা নিয়ে কোনো আশা ছিল না। আমার বয়স যখন ৯ বছর, তখন বাংলার মন্বন্তর দেখি। ৩০ লাখ মানুষ মারা যায় সেই মন্বন্তরে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখেছি; আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সেটা ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত; এক মুসলমান দিনমজুর আমাদের পাড়ায় এসেছিল; পাড়ার হিন্দু গুন্ডারা তাকে ছুরি মেরেছিল। আমি বাগানে খেলছিলাম, লোকটা রক্তাক্ত অবস্থায় আমাদের বাগানে ঢুকেছিল, সাহায্য চাইছিল, পানি পানি করছিল। আমি চিৎকার করে বাবাকে ডেকেছিলাম, বাবা এক গ্লাস পানি এনে দিয়েছিল। লোকটা আমার কোলে মাথা রেখে বাগানে শুয়ে ছিল। বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, হাসপাতালে সে মারা যায়। লোকটা আমাকে অগোছালোভাবে বলেছিল, আমি বুঝতে পারিনি, বাবা গুছিয়ে বলেছিল যে লোকটার বউ তাকে কোনো হিন্দু মহল্লায় কাজ করতে যেতে মানা করেছিল, কিন্তু লোকটা তার বউকে বলেছিল, ছেলেমেয়েগুলো কিছু খেতে পায়নি, তাদের জন্য একটু খাবার আনতে হলে তো রোজগারের জন্য যেতে হবে।

এ রকম কিছু আমি আর কখনো দেখিনি। এই অভিজ্ঞতা, দশ কি এগারো বছর বয়সে একজন মানুষকে রক্তে ভেসে যেতে দেখা; তারপর, সেই মানুষটা আমার বাবাকে যে বর্ণনা দিয়েছিল, কোন গুন্ডারা তাকে খুন করেছে, বাবা সেটা পুলিশকে জানিয়েছিল; কিন্তু ওই হিন্দু মহল্লার পুলিশ কিছুই করেনি। আমি এইসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এবং ভারত স্বাধীন হচ্ছে—এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েও আমি গেছি।

তো, আমি অনেক সমস্যা দেখেছি, তারপর সেগুলোর সমাধান হতেও দেখেছি। এর মানে এই নয় যে আমি সব সময় আশাবাদে উদ্দীপ্ত হয়ে থাকি। কোনো কিছু নিয়েই আমি অতিমাত্রায় আশাবাদী নই। এর অর্থ আবার এটা নয় যে, নিরাশ হওয়ার যথাযথ কারণ না থাকলেও নিরাশ হতে হবে।

আইজাক চটিনার: এমন কোনো বিষয় বা ক্ষেত্র কি আছে, যা নিয়ে আপনি আরও কাজ করতে চান?

অমর্ত্য সেন: কিছু দার্শনিক বিষয় আছে। আমাকে নানা বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে জ্ঞানশাস্ত্রে ফেরা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে আমাকে আরও কাজ করতে হবে।

আইজাক চটিনার: তা কি এ জন্য যে কাজটা গুরুত্বপূর্ণ? নাকি এ ধরনের কাজ আপনার পছন্দ?

অমর্ত্য সেন: দুটোই। কিন্তু আমি রাজনীতির বিষয়টা থেকে সরে যেতে পারি না; বিশেষত, ভারতে এখন যা চলছে। আমি খুব গর্বিত একজন ভারতীয়। শুধু গর্বিত ভারতীয় নই [হাসি], গর্বিত এশীয়ও, এবং একজন গর্বিত মানুষও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে প্রগতিশীল বিদ্যাপীঠে আমি পড়াশোনা করেছি, তার একটা বড় সুবিধা ছিল এই যে, আট-নয় বছর বয়সেও একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি; সেই সুযোগে আমি প্রচুর ইতিহাস পড়েছি।

আইজাক চটিনার: আমি একবার কোথাও পড়েছিলাম, আপনি নিজেকে একজন ‘অপরিবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ (আনরিফর্মড সেক্যুলারিস্ট) বলেন। আপনি কি এখনো তা-ই আছেন?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ। আসলে এটা কোনো সমস্যা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজনই নেই।

আইজাক চটিনার: নেই?

অমর্ত্য সেন: কোন ধর্মে বা কী পরিচয়ে আপনার জন্ম হয়েছে, সেটা যে কোনো বিষয়ই নয়, এই সুরাহাটা গণতন্ত্রের মধ্যেই আছে। কিন্তু গণতন্ত্র প্রায়ই ব্যর্থ হয় বলে এ বিষয়টাকে বড় করে তোলা হয়। সে জন্যই একজন মানুষের বহু পরিচয়ের বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আইজাক চটিনার: আপনার ছেলেমেয়েরা কি আপনার বই পড়ে?

অমর্ত্য সেন: খুব বেশি নয়। [হাসি]। একজন সাংবাদিক। একজন ছোটদের জন্য বই লেখে। আরেকজন মিউজিশিয়ান। আরেকজন একটা ম্যাগাজিনের সম্পাদক। আমি কখনো চাইনি ওদের বিরাট কিছু অর্জন করতে হবে, বরং চেয়েছি ওদের যা করতে ভালো লাগে, তা-ই যেন করে। ওদের কীভাবে অসাধারণ কিছু করতে হবে, এ নিয়ে আমি কখনোই আগে থেকে কিছু ভাবিনি। আমি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে একজন অভিনেত্রীকে কারাগারে যেতে হয়েছে এ জন্য যে তাঁর মেয়ে…

আইজাক চটিনার: ও, ফেলিসিটি হাফম্যান?

অমর্ত্য সেন: তিনি যা করেছেন, সেটাকে আমার বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। আপনি মনে করতেই পারেন যে আপনার সন্তানের একটা ভালো স্কুলে যাওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সেটা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। [হাসি]

আইজাক চটিনার: আপনার কি এখন গল্প-উপন্যাস পড়ার অবকাশ হয়?

অমর্ত্য সেন: এটাই ভীষণভাবে কমে গেছে। আমার দুবার ক্যানসার হয়েছিল। আমার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন প্রথমবার। আমাকে রেডিয়েশন নিতে হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আমার আর পাঁচ বছর বাঁচার সম্ভাবনা আছে; সেই সম্ভাবনাও ১৫ শতাংশ। সেটা ৬৮ বছর আগের ঘটনা। তাই আমি ভাবি যে এখন ঠিক আছি। আমাকে প্রস্টেট ক্যানসারের জন্যও চিকিৎসা নিতে হয়েছে; প্রচুর পরিমাণ রেডিয়েশন নিতে হয়েছে। অবশ্য সাম্প্রতিক পরীক্ষায় ক্যানসার ফেরার লক্ষণ পাওয়া যায়নি। চিকিৎসার সময় আমাকে একটা লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর নিয়ে শুয়ে থাকতে হতো, ফলে পড়ার সুযোগ ছিল প্রচুর। সেই সময় প্রচুর উপন্যাস পড়েছি। ছোটগল্প এখনো প্রচুর পড়ি, কিন্তু উপন্যাস পড়তে তো একটানা লম্বা সময় লাগে। আমার মনে হয় উপন্যাস পড়ার জন্য আরও সময় ব্যয় করা উচিত। আমি পড়ার জন্য আরও সময় চাই। কিন্তু মনে হয় না যে আমি তা পাব। (শেষ)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম