শিল্পমন্ত্রীর বাজারদর্শন ও ভারতের পেঁয়াজ-কূটনীতি

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ যেদিন জাতীয় সংসদে বললেন, পেঁয়াজ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, দাম নিয়ন্ত্রণেই আছে, সেদিনই পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকায় উঠেছে। এর আগে বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। বৃহস্পতিবার পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। শিল্পমন্ত্রীর বাজার নিয়ন্ত্রণের দর্শন কাজে লাগেনি। মানুষ এখন ভুলেই যাচ্ছে যে কিছুদিন আগেও পেঁয়াজের স্বাভাবিক দাম ছিল—কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, শিগগিরই পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার নিচে নামার সম্ভাবনা নেই। তারও আগে তিনি বলেছিলেন, সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে। পণ্যের দাম বাড়লেই আমরা সব সরকারের আমলে সিন্ডিকেটের কথা শুনি। কিন্তু সিন্ডিকেটে কারা আছেন, তাঁদের নাম জানা যায় না। আর জানা গেলেও তাঁরা এতটাই ক্ষমতাবান যে সরকার তাঁদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না।

পেঁয়াজ নিয়ে মন্ত্রীদের এসব কথা শুনে স্বাধীনতার পর খাদ্যসংকটকালে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদারের কথা মনে এল। যখন বাজারে চাল মণপ্রতি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, তখন খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, চালের মণ ১০০ টাকার ওপরে উঠতে দেওয়া হবে না। সঙ্গে সঙ্গে চালের মণ ১০০ টাকায় উঠে গেল। এরপর তিনি বললেন, ১২০ টাকার বেশি হতে দেওয়া যাবে না। পরদিনই চালের মণ ১২০ টাকার ওপরে উঠল।

সে সময়ে খাদ্যসংকটের পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পাঠানো গমবাহী জাহাজের গতিপথ ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যায়। কিউবার কাছে পাট বিক্রি করার অজুহাতে বাংলাদেশকে শাস্তি দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য। তবে এখনকার পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার ক্ষেত্রে কারও ষড়যন্ত্র আছে—এমন কথা কোনো মন্ত্রী-নেতা বলেননি। বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীদের বেফাঁস কথায় যে বাজার চড়ে যায়, তার অনেক উদাহরণ আছে। এরশাদ আমলে চিনির দাম এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রীর নামের সঙ্গে ‘চিনি’ যোগ হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে সবাই বলতেন ‘চিনি জাফর’।

এবারে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে বাজারের কারসাজির চেয়ে বেশি কাজ করেছে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ হওয়া। বাংলাদেশে বছরে ২৬ লাখ টনের মতো পেঁয়াজের চাহিদা আছে। দেশে উৎপন্ন হয় ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন। বাকিটা বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। যোগাযোগের সুবিধার জন্য ভারত থেকেই বেশি পেঁয়াজ আসত। এ ছাড়া মিয়ানমার, মিসর ও পাকিস্তান থেকেও কিছু পেঁয়াজ আসে। তবে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার ভারতের ওপরই বেশি নির্ভরশীল।

ঘাটতির কারণ দেখিয়ে ভারত গত সেপ্টেম্বরে হঠাৎ বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে বাজারে দফায় দফায় পেঁয়াজের দাম বেড়ে চলেছে। সমস্যাটি এতটাই গুরুতর যে গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময়ও বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। ৪ অক্টোবর আইসিটি মৌর্য হোটেলের কামাল মহল হলে আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের (আইবিবিএফ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ভারত রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় আর তাতে সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশ। ভারত এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশকে আগে জানালে ঢাকা অন্য কোনো দেশ থেকে পেঁয়াজ আনার ব্যবস্থা করে নিত।’

ইংরেজিতে দেওয়া বক্তব্যের একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ হিন্দি ভাষায় বলতে শুরু করেন, ‘পেঁয়াজ মে থোড়া দিক্কত হো গিয়া হামারে লিয়ে। মুঝে মালুম নেহি, কিউ আপনে পেঁয়াজ বন্ধ কর দিয়া! ম্যায়নে কুক কো বোল দিয়া, আব সে খানা মে পেঁয়াজ বন্ধ করদো (পেঁয়াজ নিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা। আমি জানি না, কেন আপনারা পেঁয়াজ বন্ধ করে দিলেন। আমি রাঁধুনিকে বলে দিয়েছি, এখন থেকে রান্নায় পেঁয়াজ বন্ধ করে দাও)।’ (ডেইলি স্টার বাংলা, ৪ অক্টোবর ২০১৯)

ভারত ঘাটতির কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেও মালদ্বীপে রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে। ঘাটতির কারণে ভারতেও পেঁয়াজের বাজার চড়া। আবার দাম না পেয়ে কৃষকের পেঁয়াজ ফেলে দেওয়ার খবরও সে দেশের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও বাজার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। ভোক্তা উচ্চ দামে পণ্য কিনলেও উৎপাদক ন্যায্য দাম পান না।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশে পেঁয়াজের সংকট থাকা সত্ত্বেও মালদ্বীপে পেঁয়াজ রপ্তানি করবে ভারত। এতে পরিমাণেরও কোনো হেরফের হবে না। আগে দেশটিতে যে পরিমাণ পেঁয়াজ রপ্তানি হতো, সেই পরিমাণই রপ্তানি করা হবে পেঁয়াজ। মালদ্বীপে নিযুক্ত ভারতীয় মিশন এক টুইট বার্তায় জানায়, ‘আমরা আমাদের বন্ধু মালদ্বীপকে আশ্বস্ত করতে চাই যে টানা মূল্যবৃদ্ধি ও দেশে এক লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও মালদ্বীপে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে চায় ভারত।’ ভারতে পেঁয়াজের ঘাটতি মেটাতে আফগানিস্তান, তুরস্ক, ইরান ও মিসর থেকে আমদানি করছে। তারপরও তারা মালদ্বীপে পেঁয়াজ রপ্তানি করছে।

মালদ্বীপে পেঁয়াজ রপ্তানি অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্য ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। মালদ্বীপের বাজারটি ভারত চীন বা অন্য কোনো দেশের হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। নয়াদিল্লি ও ঢাকার নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বলে থাকেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এমন মাত্রায় পৌঁছেছে, যা অন্য দেশের জন্য রোল মডেল হতে পারে। কিন্তু সেই রোল মডেল সম্পর্কও বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি নিশ্চিত করতে পারেনি। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই ভারতের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, যাতে বাংলাদেশ নয়, মালদ্বীপ অগ্রাধিকার পেয়েছে।

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় বাংলাদেশ পেঁয়াজের খোঁজে এবার পুরোনো বাজারের পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের দ্বারস্থ হয়েছে। প্রথমবারের মতো দেশটি থেকে ২০০ টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, মিসর, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকেও তো পেঁয়াজ আসছেই। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল খবর দিয়েছে, ১৫ বছর পর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আসছে। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, পাকিস্তান থেকে কমবেশি পেঁয়াজ সব সময়ই আসত। ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় এবারে আমদানির পরিমাণ বাড়বে। বাংলাদেশি ভোক্তারা ভারতীয় পেঁয়াজের স্বাদ না পেলেও পাকিস্তানি পেঁয়াজের ঝাঁজ উপভোগ করবেন।

২০০৭ সালে ভারত থেকে চাল আমদানি নিয়েও একটি সমস্যা হয়েছিল। তবে সে সময়ে দিল্লির ‘বাঙালি মন্ত্রী’ (পরে দেশটির রাষ্ট্রপতি হন) প্রণব মুখার্জির হস্তক্ষেপে ভারত ঘাটতি সত্ত্বেও পাঁচ লাখ টন চাল বাংলাদেশকে দিয়েছিল। এবারে দিল্লিতে প্রভাবশালী ‘বাঙালি মন্ত্রী’ নেই বলেই কি আমরা পেঁয়াজ–কূটনীতিতে হেরে গেলাম এবং জয়ী হলো মালদ্বীপ?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]