ডব্লিউটিওকে পঙ্গু করে দিলেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বাণিজ্যবিরোধ নিষ্পত্তিব্যবস্থা এখন পঙ্গু হয়ে গেছে। আর তা হয়েছে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংস্থাটির আপিল বিভাগকে অকেজো করে দিয়ে। ১০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের তিনজন বিচারকের মধ্যে দুজনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে নতুন দুজন বিচারক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর ন্যূনতম তিনজন বিচারক ছাড়া আপিল শুনানি করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে ডব্লিউটিওর আপিল বিভাগ অকেজো হয়ে পড়ল। ডব্লিউটিওতে প্রতিটি সদস্যদেশই যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর যেকোনো একটি সদস্যদেশ ভেটো দিলে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব, পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নাকচ হয়ে যায় বা কার্যকর করা যায় না। 

মূলত আগের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র আপিল বিভাগের বিচারক পুনরায় নিয়োগ বা নতুন নিয়োগে বাধা দিতে শুরু করে। ডব্লিউটিওর বিধান অনুসারে, আপিল বিভাগে সাতজন বিচারক থাকেন, যাঁরা চার বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং একবার পুনরায় নিয়োগ পেতে পারেন। সে হিসাবে একজন বিচারক সর্বোচ্চ আট বছরের জন্য সক্রিয় থাকতে পারেন। ২০১৭ সালের জুন ও আগস্ট মাসে দুজন বিচারকের মেয়াদ পূর্ণ হলে শূন্যপদ দুটি পূরণের জন্য ডাকা বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। ডিসেম্বর মাসে আরেকটি পদ শূন্য হলেও যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি বহাল রাখায় আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যা নেমে আসে চারজনে। এরপর গত বছর আরেকজনের আর এ বছরের শেষে এসে দুজনের মেয়াদ শেষ হয়। 

আপিল বিভাগের রায় নিয়ে অনেক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ রয়েছে। সাধারণত দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যবিরোধ দেখা দিলে বা একটি দেশ ডব্লিউটিওর কোনো বিধান লঙ্ঘন বা ভঙ্গ করে বাণিজ্য অংশীদার আরেকটি দেশের বাণিজ্যে বাধার সৃষ্টি করলে দ্বিতীয় দেশটি ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তিব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে পারে। সেখানে প্রথমে চেষ্টা থাকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা-সমঝোতায় বিরোধ মেটানোর। সেটিতে কাজ না হলে বিরোধ পর্যালোচনার জন্য প্যানেল গঠিত হয়। প্যানেল সব পক্ষের শুনানি নিয়ে ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি পর্যালোচনা করে রায়ের মতো একটি সুপারিশ দেয়। কোনো এক পক্ষ তা যৌক্তিক মনে না করলে বা সন্তুষ্ট না হলে আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হয়। আপিল বিভাগ সবকিছু বিশ্লেষণ করে প্যানেলের রায় বহাল রাখতে পারে কিংবা সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে। আপিল বিভাগের রায় প্রতিবেদন আকারে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলে সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য তার পরিপালন বাধ্যতামূলক হয়। সর্বসম্মতভাবে বলতে এখানে ‘রিভার্স কনসেনসাস’ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যার মানে হলো সব সদস্য কোনো একটি প্রতিবেদন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার বিষয়ে সম্মত হয়নি। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল অভিযোগগুলো হলো, আপিল বিভাগের বিচারকেরা মাঝেমধ্যেই তাঁদের নির্ধারিত গণ্ডি বা সীমা অতিক্রম করেন। কখনো এমনভাবে ডব্লিউটিওর বিধিবিধান ব্যাখ্যা করেন, যা সদস্যদের জন্য নতুন বাধ্যবাধকতা তৈরি করে; কখনো অতীতের কোনো রায় বা সিদ্ধান্তের উদাহরণ টেনে আনেন; আবার অনেক সময়ই সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেন না, বরং মেয়াদপূর্তির পরও চলমান শুনানির কাজ চালিয়ে যান। 

যদিও দেড় দশক ধরে ডব্লিউটিওর এই বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আমেরিকা নানাভাবে আপত্তি-অসন্তোষ জানিয়ে আসছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসে এটাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যান। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই তিনি দফায় দফায় তোপ দেগেছেন ডব্লিউটিও ওপর। ডব্লিউটিও থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে বলেছেন যে এই সংস্থা সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, বিরোধ নিষ্পত্তিতে পক্ষপাতিত্ব করে। অথচ ১৯৯৫ সালে ডব্লিউটিওর যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যতগুলো অভিযোগ দায়ের করেছে, তার ৯০ শতাংশই জিতেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ৮৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেশটি হেরেছে। 

আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ডব্লিউটিওকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার অন্যতম হলো বিরোধ নিষ্পত্তি তথা আপিল বিভাগের সংস্কার। অন্যদিকে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণের জন্য কয়েকটি মানদণ্ডও প্রস্তাব করেছে এই অভিযোগ এনে যে চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অগ্রসর ও বড় অর্থনীতির বিভিন্ন দেশ এখনো উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ডব্লিউটিওর বিভিন্ন ছাড় গ্রহণ করে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ট্রাম্প তথা যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ও প্রস্তাবগুলো যে একেবারে ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক, তা-ও বলা যায় না। তবে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যে নীতি দেশটি গ্রহণ করেছে, তা বিধিবিধানভিত্তিক বহুপক্ষীয় বিশ্ববাণিজ্য–ব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দায়িত্ব গ্রহণের পরই ট্রাম্প ‘আমেরিকা প্রথম’ বলে যে বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করেন, তা-ও আসলে বহুপক্ষীয়র বদলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতাকেই প্রাধান্য দেয়। 

আপিল বিভাগ অকার্যকর হওয়ায় ডব্লিউটিওর অস্তিত্ব বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা এই সংস্থার সবচেয়ে বড় সাফল্য। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশও এই ব্যবস্থার সুফল পেয়েছে। এই ব্যবস্থাকে অক্ষত-অব্যাহত রাখা ও প্রয়োজনে সংস্কার করার বিষয়ে ডব্লিউটিওর প্রায় সব সদস্যই একমত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু তাদের পছন্দমতো করে সংস্কার চাইছে। সে রকমটি মেনে নিলে বিশ্ববাণিজ্যে আইনের বদলে শক্তির দাপট আরও বাড়বে, অধিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে।

আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক