করোনাভাইরাসের বারতা

আগে কবুল করে নেওয়া ভালো, আমি চিকিৎসক নই, বিশেষজ্ঞও নই। একজন উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে দুটি কথা বলা।

করোনাভাইরাস স্মরণকালের প্রথম একটি মহামারি, যা সারা বিশ্বে অ্যান্টার্কটিকা ব্যতীত সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। চীন থেকে এ রোগের সূচনা, সুনির্দিষ্টভাবে বললে সে দেশের একটি প্রদেশেই মূলত সংক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ শুরুর আগেই সংক্রমণের হার পৌঁছে যায় আশি হাজারের ওপরে। তবে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থাপনায় তারা সংক্রমণের গতি সেখানেই থামাতে পেরেছে। তত দিনে উহানে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৩০৫ জনের, যাদের অধিকাংশই বয়স্ক মানুষ। অর্থাৎ মৃত্যুহার বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী ২ শতাংশের নিচে না থেকে ৪ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এরই মধ্যে এই অণুজীব ছড়িয়েছে চীনের আশপাশে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও মালয়েশিয়ায়। ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ইউরোপ, বিশেষভাবে ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাজ্যে; ফ্রান্সও সংক্রমণ ও মৃত্যুতে পিছিয়ে নেই। জার্মানি সংক্রমণ ঠেকাতে হিমশিম খেলেও মৃত্যুহার ঠেকাতে পেরেছে। আফ্রিকায় মাত্র ছড়াচ্ছে, মাত্র কিছুদিন আগে ইবোলায় এ মহাদেশে অন্তত তিনটি দেশে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশে পৌঁছেছিল। এখন মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়াচ্ছে, যার প্রধান কেন্দ্র হতে পারে ভারত। করোনায় পৃথিবী ও বিশ্ববাসী আর কত দিন ভুগবে, কতটা খেসারত গুনতে হবে, তা আগাম বলা কঠিন হলেও ভোগান্তি ও খেসারত যে অতুলনীয় হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

করোনার আগে মহামারির জন্য শহরের পর শহর লকডাউন হতে কখনো দেখা যায়নি। করোনাকে বলা হচ্ছে অতি মারি (pandemic)। ভারতবর্ষের মতো ১৩০ কোটি মানুষের গোটা দেশে ২১ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাতে শহরের খেটে খাওয়া দিনমজুর শ্রেণি ও প্রান্তিক মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে অবর্ণনীয়। কেউ কেউ নিজ গাঁয়ে ফেরার জন্য ৫০০ বা ৬০০ এমনকি এক হাজার কিলোমিটার হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন। আকস্মিক এমন লকডাউন সুবুদ্ধির পরিচায়ক হয়েছে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। পৃথিবী কখনো কি দেখেছে রোগের ভয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ হয়ে যেতে? ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা বন্ধ। একটি ক্ষুদ্র অদৃশ্য অণুজীব মহা মহাশক্তিধর, মহাধনী দেশকেও কুপোকাত করে ছেড়েছে। মানুষকে সত্যিই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

কোথাও কোথাও বাহিরমুখী মানুষকে ঠেকাতে কারফিউ দেওয়া হচ্ছে, কোথাও আমলা ও পুলিশি তৎপরতা সীমা ছাড়িয়েছে, আবার কোথাও পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকেরা জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন।

মানতেই হবে পূর্বপ্রস্তুতি তেমন না থাকলেও এবং স্বভাবগতভাবে পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমে অনভ্যস্ততার বিচারে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে। একটু বলতেই হবে, আইইডিসিআর পরিচালকের প্রাত্যহিক ব্রিফিংয়ের কথা। যেখানে মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদেরা সাধারণত নানা অস্পষ্ট কথার জাল বুনে মূল তথ্য সুস্পষ্ট করে দিতে পারেন না, সেখানে ইনি অতি অল্প কিন্তু সুনির্দিষ্ট কথায় প্রয়োজনীয় তথ্য গণমাধ্যমকে অবহিত করে যাচ্ছেন। এত দক্ষতার সঙ্গে গণমাধ্যমকে সামলাতে ইদানীং কাউকে দেখা যায়নি।

গণমাধ্যম জানাচ্ছে পর্যটকহীন বিরান কক্সবাজারের উপকূলে এখন ডলফিনেরা মহানন্দে বিচরণ করছে, মাঝে মাঝে শূন্যে ঝাঁপিয়ে, আপন আনন্দ জানাচ্ছে জনহীন সৈকতকে। বলা যেত তার অদৃশ্য শত্রুকে, কারণ মানুষ সরে যাওয়াতেই তো তার আপন বিচরণক্ষেত্র ফেরে ডলফিন ও অন্য জলচরেরা। পর্যটক এবং সমুদ্রের মাছ শিকারিদের জন্য কি এই বারতা এল না, তোমরা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলে। আকাশে বিমান চলাচল কমে গেছে, কলকারখানা বন্ধ, সড়কে গাড়ি চলাচল অতি সীমিত। ফলে বাতাসের দূষণও কমেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ুমণ্ডলে দূষণের মাত্রা অনেক কমেছে, নদী-খালের পানির উন্নতি হয়েছে। অনেকেই খবর দিচ্ছেন পাখিরা নগরেও আসছে, গাছদের আগের চেয়ে সজীব দেখাচ্ছে, বাতাসে-পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ছে। পৃথিবী তার কুমারীত্ব ফিরে পাচ্ছে নাকি যৌবন, তা জানি না; কিন্তু জীবনীশক্তি যে ফিরে পাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। এও বলা বাহুল্য, পৃথিবী বাঁচলে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সুস্থ থাকলে, মানুষও ভালো থাকবে। এ এক অমোঘ সত্য বার্তা। এখন বিশ্বের মুরব্বিরা এবং সব স্তরের নীতিনির্ধারক, চালকেরা অনেক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ সত্য বার্তা অনুধাবন করবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনার আগে আমরা আরও ভয়ংকর সব অণুজীবের আক্রমণ দেখেছি—ইবোলা, সার্স, মার্স, নিপাহ ইত্যাদি। এদের মারণক্ষমতা যথেষ্ট হলেও সংক্রমণ ছোট অঞ্চলে সীমিত ছিল এবং কম সময়ে নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছিল। কিন্তু করোনায় মৃত্যুঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম হলেও এর ছড়ানোর ক্ষমতা মারাত্মক। তা ছাড়া বৃদ্ধ এবং অন্যান্য কঠিন রোগে ভুগে বা অন্য রোগ অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তাঁদের জন্য মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। তাতে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লে এ রোগে মৃত্যুহার বাড়বেই। ইউরোপের জনমিতিতে বয়স্ক মানুষ বেশি থাকায় ইতালি ও স্পেনে মৃত্যুহার ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তা ছাড়া করোনার আগে যেমন সাম্প্রতিককালে মারাত্মক ধরনের নতুন নতুন অণুজীব মানুষকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, তেমনটা করোনার পরও ঘটবে, এমন বার্তা দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ফলে বিশ্ববাসীকে করোনার বার্তাগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং ভবিষ্যতের করণীয় ঠিক করতে হবে।

সহজ বুদ্ধিতে বার্তাগুলো এভাবে সাজানো যায়—

১. প্রকৃতি, বায়ুমণ্ডল,সমুদ্রসহ সব প্রাকৃতিক সম্পদে দূষণের সব প্রক্রিয়া এমনভাবে কমাতে হবে, যাতে বিশ্বের তাপমাত্রা ভবিষ্যতে একটুও না বাড়ে। ট্রাম্প, শি চিন পিং, মোদিসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এটা বিবেচনায় নিতেই হবে। বাংলাদেশকে কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনসহ প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যেমনটা করেছে ভুটান।
২. মানুষের জীবনযাপন ও ব্যবস্থায় যে মাত্রাতিরিক্ত ভোগবিলাস চলছে এবং কারণে-অকারণে গাড়িসহ দূষণ সৃষ্টিকারী যন্ত্রনির্ভরতা কমাতে হবে। ধনী ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা পাল্টে সমতাভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে এ প্রত্যাশাই জানানো হয়েছিল।
৩. প্রকৃতিবর্জিত বা প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাতময় উন্নয়ন মডেল পাল্টে প্রত্যেক দেশকে নিজ ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মডেল নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশকে নদী, জলাভূমি, বেলাভূমি, সুন্দরবন ও পাহাড় রক্ষা করেই উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে।
৪. যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ বন্ধ করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে খাদ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে। তা ছাড়া বর্তমান প্রবণতা দেখে যেকোনো মহামারি-অতি মারি রোধে পিপিইসহ জরুরি সরঞ্জাম এবং চিকিৎসক, নার্স, গবেষক, প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকসহ উপযুক্ত লোকবল তৈরির এবং বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের ব্যবহারের কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
এখনই দেশে ২০-২৪ বছরের তরুণদের নিয়ে জাতীয় মেডিকেল স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা যায়। আপৎকালে তাঁদের জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হবে। আর বর্তমান চিকিৎসকসহ যাঁরা সামনে থেকে রোগের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে কাজ করেছেন, তাঁদের জন্য বিশেষ ঝুঁকি ভাতা ও বিশেষ বিমার কথা ভাবা উচিত।
৫. উন্নয়ন এবং জীবনধারণ ও যাপনের পরিবর্তিত মডেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা ও উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো ঢেলে সাজাতে হবে।
৬. এটাও বোঝা যাচ্ছে, সড়ক যোগাযোগ ও চলাচলের সনাতন মাধ্যমগুলোর পাশাপাশি অনলাইনে সংযোগের সব রকম মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ানোর সক্ষমতা প্রয়োজন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তো বটেই, সার্বিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও।
সমাজে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে আড়ম্বরহীন, পরস্পর প্রতিযোগিতার মনোভাবের পরিবর্তে নির্ভরশীল সহযোগিতাপূর্ণ জীবনের বারতা দিতে হবে।

আবুল মোমেন: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক