জামিলুর রেজা চৌধুরী, যিনি আমাদের প্রতিবেদন সমৃদ্ধ করতেন

জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।
জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।

স্বার্থপর হিসেবে মানুষের সাধারণ পরিচয়, সাংবাদিকেরা কি তার চেয়ে একটু বেশি? এই প্রশ্ন মাথায় আসার কারণ—ভোরে জামিলুর রেজা চৌধুরীর মারা যাওয়ার খবর শোনার পর প্রথম মাথায় আসে—এরপর আর কার কাছ থেকে চমৎকার উদ্ধৃতি পাব। সংবাদপত্রে অসংখ্য প্রতিবেদন তৈরির জন্য ড. চৌধুরীর উদ্ধৃতি ছিল অনিবার্য। তাঁর বক্তব্য প্রতিবেদনে ভারসাম্য আনত। তাঁর কথা দিয়েই প্রথম আলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন শেষ করতাম আমরা, যাতে পাঠক মনে করেন, ওটাই প্রথম আলোর বক্তব্য।

কত বিশেষণ যে এই মানুষটির প্রাপ্য, তা বলে শেষ করা যাবে না। জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তবে প্রথমেই বলতে হয়, তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন, সাদা মনের মানুষ বলতে যা বোঝায়, তার প্রতিকৃতি ছিলেন এই শিক্ষক। সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপকে ভূষিত করেছে, সত্যিকার অর্থেই এ গুণী মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন জাতির শিক্ষক।

কনিষ্ঠ সহকর্মীরা অনেক সময় প্রশ্ন করতেন, স্যারের পরিচয় কী দেব? আসলে তাঁর পরিচয় এবং বহুমাত্রিক প্রতিভা এত বেশি ছিল যে তাঁকে কোন পরিচয় দেওয়া জুতসই হবে, তা নিয়ে কনিষ্ঠরা বিভ্রান্তিতে পড়তেন। একপর্যায়ে যে বিষয়ে প্রতিবেদন, সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর পরিচয় দেওয়া শুরু হয়। শিক্ষা নিয়ে তাঁর মন্তব্য নিলে শিক্ষাবিদ, জাতীয় অধ্যাপক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোথাও প্রকৌশলী বা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কোথাও বুয়েটের অধ্যাপক, আবার কোথাও সড়ক ও সেতু বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি পরিচয় ব্যবহার করা হতো। যদিও জামিলুর রেজা চৌধুরী নামটি বললে বিশেষণ প্রয়োজন ছিল না, তবু কাউকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ থেকে আমরা পরিচয় খুঁজতাম।

অবশ্য তাঁর উদ্ধৃতি পাওয়াটা একটু কঠিন ছিল। তিনি যা বলেছেন, তা থেকে একটু নড়চড় হলে বিরক্ত হতেন। এ জন্য বেশির ভাগ সময়ে তাঁর উদ্ধৃতি পড়ে শোনাতাম, সহকর্মীদেরও বলতাম এটা করতে। ড. চৌধুরীর আরেকটি সংক্ষিপ্ত নাম তৈরি হয়ে যায়, যেটি ছিল জেআরসি। তিন শব্দের বড় নাম সংক্ষেপ করে কে বা কারা এবং কখন জেআরসি পরিচয় শুরু করেন, সে বিষয়টি অবশ্য জানা নেই।

বর্ণাঢ্য জীবন বলতে যা বোঝায়, তার প্রতিকৃতি ছিলেন জামিলুর রেজা। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন ড. চৌধুরী। তিনি সব সময় জাতীয় স্বার্থে কথা বলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। সরকার বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হবে কি না, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি।

১৯৯৬ সালে প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। জীবনের শেষভাগে দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন, প্রথমে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে। ২০০০ সালের দিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জন্মলগ্নে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব নেন। বুয়েটে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক বছর আগেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্নে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি ছাড়ার সময় এটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে।

১৯৬৩ সালে বুয়েটে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষা শেষে আবার বুয়েটে ফিরে আসেন। ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি করেছেন বহুতল ভবন বিষয়ে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢাকায় শিল্পব্যাংক ভবনের ডিজাইনে প্রথম যুক্ত হন। স্বাধীনতার পর দেশের প্রায় সব বড় অবকাঠামোর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।

এত বড় প্রকৌশলী হয়ে দেশে কেন রয়ে গেলেন?—এ বিষয়ে জেআরসির বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। বলতেন, ‘অনেকবার সুযোগ পেয়েছি, কখনো শিক্ষক হিসেবে, কখনো পরামর্শক হিসেবে। আবার আমার সমসাময়িক প্রায় সবাই বিদেশে চলে গেছেন। সেই মানসিক চাপ অনুভব করতাম। কিন্তু সব সময় মনে হয়েছে, এই দেশকে কিছু দিতে হবে। অনেকটা বিনা পয়সায় পড়েছি। এ দেশেরও তো প্রাপ্য আছে।’ একটু চাপা গলায় বলতেন, এটা দেশপ্রেমও হতে পারে। এত বড় মাপের মানুষ হলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেন। তাঁর ভাষায়, তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে তিনি আনন্দ পান।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে অবদান রাখা ছাড়াও গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি। সুবক্তা ছিলেন। চেহারায় রাগ বা বিরক্তি ছিল বিরল ঘটনা। নিরহংকার ও সদালাপী মানুষের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। একুশে পদক পেয়েছেন। প্রকৌশলী সমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ছিলেন ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইবি) সভাপতি।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বুয়েটসহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তিনি হতে চাননি। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলে রাজনৈতিক চাপ আসবে। ছাত্ররা আন্দোলন করবে, শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধটা এখন প্রকট। রাতের বেলাও সতর্ক থাকতে হবে, ক্যাম্পাসে কোথায়, কী হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, ‘আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, শান্তিতে ঘুমাতে চাই।’

শান্তিতে ঘুমান শ্রদ্ধেয় জনাব। অনেক করেছেন, অনেক কিছু দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে। আমরা কৃতজ্ঞ ও ধন্য আপনার মতো গুণী মানুষের সহায়তা পেয়ে, সাহচর্যে এসে।

শরিফুজ্জামান, হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো।