কেরালা থেকে বাংলাদেশ যা শিখতে পারে

কেরালা সরকার এপ্রিলের শুরুতেই পথেঘাটে কিওস্ক বসিয়ে সাধারণ মানুষের করোনা পরীক্ষা শুরু করে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেরালা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম রোল মডেল। ছবি: রয়টার্স
কেরালা সরকার এপ্রিলের শুরুতেই পথেঘাটে কিওস্ক বসিয়ে সাধারণ মানুষের করোনা পরীক্ষা শুরু করে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেরালা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম রোল মডেল। ছবি: রয়টার্স

১৪ মে দ্য ডেইলি স্টারে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুরের ‘কেরালা মডেল’ শিরোনামের একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে কীভাবে করোনাভাইরাস মহামারি প্রতিরোধে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে সফল রাজ্য হিসেবে কেরালা সারা বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ভারতে প্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছিল কেরালা রাজ্যেই। চীনের উহানফেরত একজন মেডিকেল ছাত্র সবার আগে ভারতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন ১৮ জানুয়ারি। যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৪ মার্চ ভারতে লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন, তখন ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে কেরালায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ভারতের মধ্যে সবার আগে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসায় সফল হয়েছে এই কেরালা। চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও কেরালায় মহামারিতে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম এবং মৃত্যুহার মাত্র শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছে। 

কেরালার এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের মূলমন্ত্র কী? রাজ্যজুড়ে অতিদ্রুত করোনা টেস্টিং, ট্রেসিং অব কন্টাক্টস এবং ট্রিটমেন্টকে (ট্রিপল-টি) সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আক্রান্ত পরিবারকে ২৮ দিনের কোয়ারেন্টিনে নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা কঠোরভাবে পালন করে চলেছে কেরালা, যেখানে ভারতের অন্য রাজ্যগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন চালু করছে। ওই ১৮ জানুয়ারি কেরালা করোনা অ্যালার্ট জারি করে রাজ্যের চারটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা সব যাত্রীকে বাধ্যতামূলক চেকআপের আওতায় নিয়ে এসেছে এবং সন্দেহজনক কেসগুলো হাসপাতালে অথবা কোয়ারেন্টিনে নিয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে পুরো কেরালা রাজ্যকে ‘কোভিড-১৯ ডিজাস্টার এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে। মার্চের প্রথম দিকেই স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অনুষ্ঠান-সভা-জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যেখানেই প্রয়োজন সেখানে লকডাউন আরোপ করা হয়েছে। সারা ভারতে ২৪ মার্চ যখন লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, তার আগেই কেরালায় ৩০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর সক্রিয় অংশগ্রহণে হাজার হাজার মানুষ কোয়ারেন্টিনের আওতায় চলে এসেছিল। এই ‘টোটাল মবিলাইজেশন’ কেরালায় সম্ভব হয়েছিল বহু বছর ধরে যথোপযুক্ত অর্থায়নসহকারে প্রধান অগ্রাধিকার দিয়ে গড়ে তোলা কেরালার পাবলিক হেলথ ব্যবস্থার কারণে। 
শতভাগ জনগণের অভিগম্য আধুনিক জনস্বাস্থ্য কাঠামো গড়ে তুলেছে কেরালা। কেরালার লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি মানবিক এবং সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কুদুমবাশ্রি নামের এক এলাকার তৃণমূল সংগঠন ও নারী সমিতির সদস্যরা মহামারি সংক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ২০ লাখ মাস্ক এবং ৫ হাজার লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরকে সরবরাহ করেছেন। উপরন্তু তাঁরা ১ হাজার ২০০ কমিউনিটি কিচেন প্রতিষ্ঠা করে প্রতিদিন ৩ লাখ মানুষকে রান্না করা খাদ্য সরবরাহ করছেন। কেরালা ভারতের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক অভিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল। অতএব কোনো অভিবাসী পরিবার বিপদে পড়লে তাদের সহায়তা প্রদানেও কেরালার জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসন খুবই সক্রিয়। ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য কেরালা। তাই মহামারির ‘কমিউনিটি সংক্রমণের’ ঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা কেরালায়। অথচ কেরালা মহামারির কমিউনিটি সংক্রমণ এবং এ-সংক্রান্ত মৃত্যুকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখায় সফল হয়েছে। 
মনে রাখতে হবে, রাজ্যটি বিশ্বকে ‘উন্নয়নের কেরালা মডেল’ উপহার দিয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকের স্কোরে কেরালা ভারতের সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে ১৯৯০ সাল থেকেই। সর্বশেষ ২০১৮ সালের কেরালার এইচডিআই শূন্য দশমিক ৭৭৯ এবং ভারতের এইচডিআই শূন্য দশমিক ৬৪৭। শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, জন্মহার, মৃত্যুহার, মোট প্রজনন হার, জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার, ভর্তুকি দামে খাদ্য-রেশন ও ফিডিং ব্যবস্থা, চিকিৎসক-জনসংখ্যা অনুপাত—এ ধরনের সামাজিক সূচকে কেরালা অনেক উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কেরালার জনগণ ৯৪ শতাংশ শিক্ষিত এবং শতভাগ মৌল স্বাস্থ্যসুবিধা ও চিকিৎসাসুবিধার আওতায় চলে এসেছে। ধনীদের জন্য ব্যয়বহুল হাসপাতাল গড়ে তোলার চেয়ে অর্থনৈতিক অবস্থান-নির্বিশেষে সব মানুষকে সুলভ অথচ আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাসেবা পৌঁছানোর ব্যাপারে কেরালা বেশি যত্নবান। কেরালার নিম্ন আয়ের মানুষ বিপুল ভর্তুকি দামে রেশনের চাল কিনছে। কেরালার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্কুল ফিডিংয়ের আওতায় চলে এসেছে। কেরালার সব প্রবীণ কৃষক মাসিক পেনশন পান। ন্যায়বিচার সমুন্নতকারী প্রবৃদ্ধি মডেলের এক অনন্য নজির কেরালা। আয় ও সম্পদবৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণের মাথাপিছু জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে দ্রুত বাড়িয়ে চলেছে রাজ্যটি। কেরালায় পরমতসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ)। সে জন্যে কেরালার জনসাধারণ তাদের রাজ্যকে ‘গড’স ওন কান্ট্রি’ নামে অভিহিত করে। 
অন্যদিকে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে বাংলাদেশ ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ দর্শনকে অনুসরণ করে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাজার ও ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করার নীতি বাস্তবায়ন করে চলেছে। এ দেশে ধনাঢ্য, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের জন্য ব্যয়বহুল হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠার হিড়িক চলেছে চার দশক ধরে। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সেবায় সরকারি ভর্তুকি কমানোর কারণে জনগণের চিকিৎসা খরচের প্রায় ৭৭ শতাংশ এখন জোগান দিতে হচ্ছে ব্যক্তিগত/ পারিবারিক ফান্ড থেকে। সরকারি বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বরাদ্দ কয়েক দশক ধরেই জিডিপির এক শতাংশের কম। 
দেশের গ্রামাঞ্চলে যে কয়েক হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলো অব্যবস্থাপনা ও অকিঞ্চিৎকর অর্থায়নের শিকার হয়ে নামকাওয়াস্তে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স ও হেলথ টেকনোলজিস্ট না থাকায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেরাই প্রতিবন্ধী অবস্থায় চলে গেছে। ওগুলোর বেশির ভাগই এখন আরোগ্য নিকেতন বিবেচিত হওয়ার পরিবর্তে ‘নিম্নবিত্তের মরণের কারখানায়’ পরিণত হয়েছে। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন রাজনৈতিক ও পেশাজীবী লবিস্টদের দখলে চলে গেছে। এমনকি মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদটিও বোধ হয় এখন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় না! এমতাবস্থায়, করোনাভাইরাস মহামারি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম দুর্গতির চিত্রটি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। 
পত্রিকায় দেখলাম, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ১৪ মে এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, মহামারির মোকাবিলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ‘মুখ থুবড়ে পড়েছে’। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে মুনাফাবাজিতে যতখানি আগ্রহী, তার তুলনায় মহামারি রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে তাদের অবিশ্বাস্য ও অমানবিক অনীহা এবং প্রস্তুতির অভাব অত্যন্ত নগ্নভাবে এবার ধরা পড়ে গেছে। অর্থনীতিতে ‘বাজার ব্যর্থতা তত্ত্ব’ যে সত্যটি বহুদিন আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে তা হলো, সাধারণ নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণের কাছে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কখনোই সমর্থ হবে না প্রাইভেট সেক্টর এবং বাজারীকরণ। বিশ্বের সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাত এবারের করোনা মহামারির মৃত্যুর মিছিল থামাতে যে অবিশ্বাস্য ব্যর্থতা দেখিয়েছে ও চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, তা থেকে বিশ্ব নিশ্চয়ই শিক্ষা নেবে যে দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা কখনোই শুধু বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পঙ্গু এবং মরণাপন্ন অবস্থায় ঠেলে রেখে মুক্তবাজার অর্থনীতির আফিমের মৌতাতে মশগুল থাকলে মহামারির মৃত্যুর মিছিল মোকাবিলায় লেজেগোবরে অবস্থায় পড়তে হবে সবচেয়ে সম্পদশালী অর্থনীতির পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকেও। 
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ‘কেরালা মডেল’ এখনো আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য অনুকরণীয় মডেল হতে পারে। দেশে যে কয়েক হাজার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলোকে কেরালার স্বাস্থ্য কাঠামোর আদলে পরিপূর্ণভাবে ঢেলে সাজানোর সুযোগ রয়েছে। কেরালার আদলে আমাদের দেশেও মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ এবং হেলথ টেকনোলজিস্ট ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলার ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা যায়। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য প্রশাসন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সমাজ অভিভাবকদের মনিটরিং নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায়। কেরালার আদলে সব মানুষকে আধুনিক অথচ সুলভ স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসা যায়। এ প্রসঙ্গে যে বিষয় সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তা হলো, কেরালার স্বাস্থ্যব্যবস্থা শিক্ষা নিয়েছে সমাজতান্ত্রিক কিউবার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে। কিউবার জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আকুল আবেদন, ইতিহাস আপনাকে সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে করোনা মহামারির প্রতিরোধযুদ্ধে সফল করার জন্য কেরালা ও কিউবার আদলে এর খোলনলচে বদলে ফেলুন।

মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।