কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অসন্তোষ কমবে না

পুলিশের অত্যাচারে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল হিলের সামনে এভাবে হাটু মুড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। ছবি: রয়টার্স
পুলিশের অত্যাচারে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল হিলের সামনে এভাবে হাটু মুড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। ছবি: রয়টার্স

সোমবার ওয়াশিংটন ডিসিতে শক্ত হাতে নাগরিক বিক্ষোভ দমনের জন্য নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের বাইরে জমায়েত কয়েক হাজার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীকে রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস দিয়ে হটিয়ে দেওয়ার পর তিনি হেঁটে পার্শ্ববর্তী গির্জায় গিয়ে বাইবেল হাতে ছবি তোলেন। পরে এক টুইটে তিনি ঘোষণা করেন, ওয়াশিংটন ডিসিতে কোনো সমস্যা নেই। বিপুল ক্ষমতা প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘এ জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ’।

খেলা শেষ হওয়ার আগেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে বসেছিলেন ট্রাম্প। পরদিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার, ন্যাশনাল গার্ডের উপস্থিতি সত্ত্বেও কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী আবার হোয়াইট হাউসের সামনে জমায়েত হন। কোনো অঘটন ঘটেনি, কিন্তু সামরিক উপস্থিতির কারণে তাঁরা ভীত নন, এ কথাও বিক্ষোভকারীরা বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেন। এদিন শুধু ওয়াশিংটন ডিসি নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১ হাজার শহরে ছোট-বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক অসন্তোষ ঠেকাতে প্রায় ২০০ শহরে কারফিউ দেওয়া হয় ও ১৭ হাজার ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়। তা সত্ত্বেও বিক্ষোভ ঠেকানো যায়নি। পুলিশের হাতে নিহত জর্জ ফ্লয়েডের জন্মস্থান হিউস্টনে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। অনেক শহরে কারফিউ লঙ্ঘন করা হয়। নিউইয়র্কসহ একাধিক শহরে লুটপাটের ঘটনাও ঘটে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবিলম্বে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সোমবার দেশের গভর্নরদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় তিনি তাঁদের ‘দুর্বল’ বলে উপহাস করেন এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ‘রাস্তার দখল’ গ্রহণের দাবি জানান। একাধিক গভর্নর ও মেয়র তাঁর সে নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন। ইলিনয়ের গভর্নর ট্রাম্পের মুখের ওপরেই জানিয়ে দেন, গরম-গরম কথা বলে ট্রাম্প পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলছেন। আটলান্টার মেয়র তাঁকে পরামর্শ দেন, দয়া করে কম কথা বলুন।

অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলায় সামরিক বাহিনীর ব্যবহারে বিভিন্ন মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে খোলামেলাভাবেই বলছেন, তৃতীয় বিশ্বের অনেক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে এমন ঘটনা হামেশা ঘটলেও আমেরিকায় যে তা ঘটবে, সেটি তাদের কল্পনার বাইরে ছিল। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা সরাসরি প্রশ্ন রেখেছে, আমেরিকা কি তাহলে ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে হাঁটছে? একজন সিআইএ বিশ্লেষকের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, ট্রাম্প যা করছেন, তৃতীয় বিশ্বের অনেক একনায়ক তা-ই করে থাকেন। ‘কোনো রাষ্ট্র ব্যর্থ হওয়ার আগে ঠিক এই রকম ঘটনাই ঘটে।’

আমেরিকা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, এ কথা অবান্তর, তবে এর চরিত্র ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর সারা দেশে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার গুরুত্ব অনুধাবনের বদলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘বিপুল ক্ষমতা প্রয়োগের’ কথা বলেছেন। সে কথা উল্লেখ করে সিনেটর কমলা হ্যারিস বলেছেন, ট্রাম্প একজন ডিক্টেটর। সামরিক শক্তির প্রতি তাঁর মুগ্ধতা ট্রাম্প বরাবরই প্রদর্শন করেছেন। নিজের ক্যাবিনেটে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাবেক জেনারেলের উপস্থিতি সে কথার প্রমাণ। চলতি নাগরিক বিক্ষোভ ঠেকাতে তিনি শুধু সেনাবাহিনী নিয়োগের নির্দেশই দেননি, মার্কিন যৌথ বাহিনী প্রধান জেনারেল মিলিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে নেতৃত্ব গ্রহণেরও নির্দেশ দেন।

দেখাই যাচ্ছে সামরিক শক্তির উপস্থিতি নাগরিক বিক্ষোভ দমনে সক্ষম হয়নি, বরং তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্প ও রিপাবলিকান নেতৃত্ব এখনো এ কথা স্বীকার করতে পারেননি যে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশি ব্যবস্থা গভীরভাবে বর্ণবাদী। এ দেশের কালো ও বাদামি মানুষেরা এই ব্যবস্থার শিকার। আমেরিকান জার্নাল অব পাবলিক হেলথের এক গবেষণা অনুসারে আমেরিকায় শ্বেতকায়দের তুলনায় কৃষ্ণকায়দের পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার আশঙ্কা তিন গুণ বেশি। প্রতিবছর এ দেশে পুলিশের হাতে কৃষ্ণকায়দের বিরুদ্ধে এক হাজারের বেশি অত্যধিক শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ঘটে, যার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো পুলিশকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয় না। শাস্তি পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। গত ১০ বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে যে কয়েকটি তদন্ত ও শাস্তির ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটি সম্ভব হয়েছে ব্যাপক নাগরিক বিক্ষোভের পর।

আমেরিকার কালো মানুষদের অপরাধী বা ক্রিমিনাল হিসেবে দেখার প্রবণতা সুপরিচিত। এর পেছনে রয়েছে এ দেশের ৪০০ বছরের পুরোনো দাসপ্রথা ও বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কালোদের ‘ঠান্ডা’ করার একমাত্র পথ তাদের জেলে ঢোকানো, এই বিবেচনা থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কঠোর ব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। এর পেছনে প্রচ্ছন্ন নির্বাচনী বিবেচনা কাজ করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্বেতকায়, বিশেষত শহরতলির শিক্ষিত শ্বেতকায় নারী ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্যই তিনি নিজেকে ‘আইনশৃঙ্খলার প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রমাণে উদ্যোগী হয়েছেন। ২০১৬ সালে এই রণকৌশল ব্যবহার করেই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তাহলে কি অবস্থা কিছুতেই বদলাবে না, এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মিডিয়াম নামক ওয়েবসাইটে এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া প্রকৃত পরিবর্তন আসবে না। ‘পরিবর্তনের পক্ষে যে দাবি, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন আইনি ব্যবস্থায় ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন। কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেই পরিবর্তন সম্ভব, যখন আমাদের এই সব দাবির প্রতি সহমত পোষণ করে, এমন সরকার নির্বাচিত করা।’

আর মাত্র পাঁচ মাস পরই আমেরিকায় জাতীয় নির্বাচন। তেমন একটি সরকার গঠনের সুযোগ এ দেশের মানুষ পাবে, কিন্তু সে সুযোগ তারা ব্যবহার করবে কি না, সেটি এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে।