অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাব্য পথ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ ও আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাব্য পথ অনুসন্ধান এখন সময়ের দাবি। আমরা যতই বলি না কেন মহামারি, দুর্যোগ এবং জনস্বাস্থ্য বা অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রভাব কোনোটাই বিশ্বে বা আমাদের দেশে কোনো নতুন বিষয় নয়। আমাদের দেশেও ডেঙ্গু ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় আগেও ঘটেছে।

আমার মনে পড়েছে, ১৯৯১–এর বন্যার পর আইএমএফের সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য সহায়তার আলোচনার জন্য অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাদের মতো কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও কর্মকর্তার ওপর। আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করি এবং অর্থনৈতিক অভিক্ষেপ প্রস্তুত করি। পরে লক্ষ করি যে অর্থনীতি আশাতীত দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়। এর প্রধান কারণ ছিল বন্যার পানিতে পলি আসে, ফলে কৃষিতে বাম্পার ফলন হয়। এ ছাড়া অন্যান্য খাতও ক্ষতি মেটাতে তৎপর হয় এবং বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। 

ইংরেজি বর্ণমালা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাব্য পথ 

বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিপর্যয়ের পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এটা পাঁচটি সম্ভাব্য পথ অনুসরণ করে থাকে। ১. অর্থনীতি যদি দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়, তাহলে তা হবে ইংরেজি বর্ণমালা ‘ভি’–এর মতো। অর্থাৎ দ্রুত খাদে নেমে আবার দ্রুত উঠে আসে। ২. বিপর্যয় যদি পরপর দুবার হয় এবং প্রতিবারই খাদ থেকে দ্রুত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয়, তাহলে তা হবে ইংরেজি বর্ণমালা ‘ডব্লিউ’–এর মতো। ৩. অর্থনীতি পুনরুদ্ধার যদি বিলম্বিত হয়, তবে তা হবে ইংরেজি বর্ণমালা ‘ইউ’–এর মতো। অর্থাৎ দ্রুত উঠে না এসে বেশ কিছুটা সময় খাদে থেকে বেশ পরে অর্থনীতি আগের পর্যায়ে এসে আবার প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ৪. হতাশাজনক পরিস্থিতি হচ্ছে অর্থনীতি খাদ থেকে উঠতে না পেরে খাদেই অগ্রসর হতে থাকে, যা ইংরেজি বর্ণমালা ‘এল’–এর মতো। ৫. সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে ওপরে–নিচে দুটো ‘এল’ অর্থাৎ সিঁড়ির মতো খাদে পড়ার পর না উঠেই আবার খাদে পড়া এবং নিচের খাদেই অগ্রসর হতে থাকে। 

আগেই বলেছি, ১৯৯১–এর বন্যার পর দ্রুত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয়। অর্থাৎ ইংরেজি বর্ণমালা ‘ভি’–এর মতো। 

এবার কী ঘটতে যাচ্ছে 

মনে রাখতে হবে, এবারের সংকটের ব্যাপকতা অনেক বেশি। ১৯৯১–এর বন্যার সময় উপদ্রুত এলাকা বাদে বাকি এলাকায় জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। এবার সারা দেশেই জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। উৎপাদন কমেছে ও বেকারত্ব বেড়েছে। আগে সংকট কেবল দেশেই সীমিত ছিল। এবার বহিঃ অর্থনীতিতেও বিরাট ধাক্কা লেগেছে। যার ফলে রপ্তানি ও প্রবাসী কর্মসংস্থান কমেছে। প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসছেন, যা রেমিট্যান্সের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সব মিলিয়ে মোট দেশজ উৎপাদন কমার আশঙ্কা রয়েছে। 

তুলনীয়, সাম্প্রতিক (২০০২-২০০৪) সার্স মহামারির পর বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি দ্রুত বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে। অর্থাৎ ভি প্যাটার্ন অনুসরণ করে। তবে মনে রাখতে হবে যে সার্সের ব্যাপকতা ছিল অনেক কম। দুই বছর ধরে এর প্রকোপ থাকলেও মাত্র ২৯টি দেশে এর সংক্রমণ ঘটে। আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল ৮ হাজারের কিছু বেশি এবং মৃতের সংখ্যা ৭৭৪। তার বিপরীতে কোভিড-১৯ সংক্রমিত দেশ ও অঞ্চলের সংখ্যা ২১৩, আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ৬১ লক্ষাধিক এবং মৃতের সংখ্যা ৪ লাখের কাছাকাছি। সর্বোপরি এ রোগের কোনো চিকিৎসা বা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন নেই। 

বাংলাদেশে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া কী হবে, তা নির্ভর করবে নিচের বিষয়গুলোর ওপর। 

১. কত দ্রুত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থামানো, আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ও মৃতের সংখ্যা কত কমে সীমিত রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে সফল হলে উত্তরণ–প্রক্রিয়া ভি প্যাটার্ন হওয়ার অর্থাৎ অর্থনীতি দ্রুত খাদ থেকে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। ব্যর্থ হলে উত্তরণ–প্রক্রিয়া ইউ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে অর্থাৎ অর্থনীতি দীর্ঘ সময় খাদে অবস্থান করবে বা পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। 

২. করোনাভাইরাসের বর্তমান প্রকোপ মুক্ত হওয়ার পর দ্বিতীয়বার তা ফিরে আসে কি না, যেমনটি ঘটেছে সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফল হলেও উত্তরণ–প্রক্রিয়া ডব্লিউ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে অর্থাৎ অর্থনীতি দুবার খাদে পড়বে এবং ফলে পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। 

৩. আমাদের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ, শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সৌদি আরব, আরব আমিরাত, পূর্ব এশিয়ায় সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সাফল্য ও তাদের অর্থনীতি কত দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তার ওপর। সেসব দেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থতা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিলম্ব আমাদের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে বিলম্বিত করবে। 

৪. সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ও দরিদ্র সহায়তা কর্মসূচির সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর। যদি প্রণোদনা সঠিক লোকের হাতে পৌঁছায় এবং তা সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তাহলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত হবে অর্থাৎ ‘ভি’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। আর যদি তা বেহাত হয়ে যায় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তাহলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিলম্বিত হবে অর্থাৎ ‘ইউ’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। 

৫. দরিদ্রদের সহায়তা যদি সঠিক লোকের কাছে পৌঁছায়, তাহলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত হবে অর্থাৎ ‘ভি’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। আর যদি তা বেহাত হয়, তাহলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিলম্বিত হবে অর্থাৎ ‘ইউ’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। আর সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ও দরিদ্র সহায়তা দুটোই যদি বেহাত ও অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তাহলে অর্থনীতি খাদেই এগোতে থাকবে অর্থাৎ ‘এল’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। 

৬. এটা আরও নির্ভর করবে প্রশাসনের কার্যকারিতার ওপর। স্বাস্থ্য প্রশাসন যদি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এবং সার্বিক প্রশাসন যদি সরকারের আর্থিক, দারিদ্র্য সহায়তা নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত হবে অর্থাৎ ‘ভি’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। আর এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিলম্বিত হবে অর্থাৎ ‘ইউ’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। 

৭. সবশেষে এটা নির্ভর করবে ব্যক্তি খাত, এনজিও, নাগরিক সমাজ, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার ওপর। যদি সবাই মনে করে এটি একটি জাতীয় সংকট এবং সম্মিলিতভাবে এর মোকাবিলা করতে হবে এবং এ জন্য তৎপর হয়, তাহলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত হবে অর্থাৎ ‘ভি’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। আর অন্যথা হলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিলম্বিত হবে অর্থাৎ ‘ইউ’ প্যাটার্ন অনুসরণ করবে। 

আমরা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আশাবাদী হতে চাই। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক কোভিড টেস্ট পরিচালনায় অসামর্থ্য, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে অতিমাত্রায় ব্যবসায়ী নির্ভরশীলতা, ত্রাণসামগ্রী চুরি ও বিনিময়ে অনিয়ম, দরিদ্র তালিকায় একই মোবাইল নম্বরের অসংখ্যবার উপস্থিতি, রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য ও মামলার তদন্তাধীন ধনকুবেরদের চার্টার্ড ফ্লাইটে দেশত্যাগ আমাদের হতাশ করেছে। তাই ভয় হয়, আমাদের ব্যর্থতার কারণে অর্থনীতি না দুটো ‘এল’–এর সিঁড়ির গহ্বরে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়! 

আমাদের সামনে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। দেশের মানুষ ও অর্থনীতি বাঁচানোর যুদ্ধ। প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অর্জনকে আমরা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেব না। অগ্রযাত্রার যে সোপানে আমরা আরোহণ করেছি, আশা করি তা ধরেই এগিয়ে যাব। 


মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ