পুনরুদ্ধার তহবিলেই মুক্তি দেখছে ইউরোপ

চার দিন ও চার রাতের কড়া দর–কষাকষি ও অনেক কষ্টসাধ্য সমঝোতার পর ইউরোপীয় নেতারা ৮৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের একটি পুনরুদ্ধার তহবিল গঠনের চুক্তি করেছেন। ইতালি, স্পেন ও অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো এখন পর্যন্ত কোভিড–১৯ মহামারিতে জেরবার। এ চুক্তিকে তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংহতি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও করোনার অভিঘাতে ইউরোজোনের সমস্যা এতই গভীর হয়েছে যে এ তহবিল দিয়ে তার অতি সামান্যই সমাধান করা যাবে।

এ মহামারি ইউরোপের দেশগুলোর আর্থিক বন্ধনকে একেবারে ভাঙনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। দেশগুলো যখন একে অন্যের সঙ্গে নিজেদের দুর্দশার কথা বিনিময় করেছে, তখন দেখা গেছে কিছু দেশের কষ্ট অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনে মহামারিতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি এবং এসব দেশ গভীর মন্দায় ডুবে গেছে।

পর্যটননির্ভর দক্ষিণ ইউরোপ এখন একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ইউরোজোনের দেশগুলোর দেনার পাল্লা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে ইতালির অবস্থা ভয়ানক মাত্রায় পৌঁছেছে। ইতালির সাধারণ মানুষ তাদের এ দুর্দশার জন্য উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর উদাসীনতাকে দায়ী করছে। তাদের সে অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়।

ইতালিতে সংক্রমণের শুরুর দিকে ইতালিকে যে সহায়তা করা দরকার ছিল, তা তারা পায়নি। তবে শেষ পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ইতালির সহায়তায় এগিয়ে আসেন এবং গত মে মাসে তিনি এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইতালির জন্য ৫০ হাজার কোটি পাউন্ডের একটি পুনরুদ্ধার তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছেন। ওই ফ্রাঙ্কো–জার্মান প্রস্তাবের অঙ্কটিকে ইউরোপীয় কমিশন ৭৫ হাজার কোটি পাউন্ডে উন্নীত করেছে। তারা এ অর্থ সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে ইতালিকে দেবে। ২১ জুলাই ভোরে ইইউ নেতারা চুক্তির মাধ্যমে ইতালি ও অন্য মহামারিকবলিত ইউরোপীয় দেশগুলোকে সহায়তা দিতে রাজি হয়।

যেকোনো চুক্তি নিয়ে আশঙ্কা থাকে, শেষ মুহূর্তে ঐকমত্য না–ও হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্রুত সবাই একমত হতে পেরেছে। ম্যার্কেল–মাখোঁর প্রস্তাবে এবং তাঁদের অনুরোধে ইইউ ৩৯ হাজার কোটি ডলার খুব কম শর্তে ছাড় করেছে। এ অর্থ আগামী তিন বছর অর্থনৈতিক উন্নয়নধারাকে গতিশীল করতে ব্যয় করা হবে।

আশা করা হচ্ছে এ অর্থের প্রণোদনায় আগামী তিন বছর ইউরোপের দেশগুলোতে গড়ে ১ শতাংশ করে জিডিপি যোগ করবে। ইতালির অর্থনীতি এ বছরই ১০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। এর ধসের গতির রাশ টেনে ধরতে এ তহবিল বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ তহবিল গঠনের সবচেয়ে বড় লাভ অবশ্য রাজনৈতিক। এর ফলে ইইউর পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে, আর সে কারণেই সদস্য কোনো দেশ বিরাগভাজন হয়ে ইইউ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারবে না।

আরেকটি বিষয় হলো ইইউ সদস্যদেশগুলোর কয়েকটিতে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বাড়বাড়ন্ত ইইউকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যেমন হাঙ্গেরির ভিক্তর ওরবান সরকার জনতুষ্টিবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইইউর মৌলিক আইনকানুনকে পাশ কাটিয়ে ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ তহবিল থেকে তাদের শর্তযুক্ত ঋণ দিয়ে সেই স্বেচ্ছাচারের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হবে। এই দিকে জোর দিয়েই মূলত ম্যার্কেল তহবিলটি গঠনে বেশি আগ্রহী হয়েছেন।

২০১০–১২ সালের ইউরোজোন সংকটের পর হাঙ্গেরিয়ান–আমেরিকান ধনকুবের ও দানবীর জর্জ সোরোস বলেছিলেন, ম্যার্কেল সব সময়ই ইউরোকে শক্তিশালী রাখার চেষ্টা করে থাকেন এর বেশি কিছু নয়। এটি আবারও সত্য হলো।

এ পুনরুদ্ধার তহবিল সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে। এতে ইউরো মুদ্রা শক্তিশালী হবে। যদিও ইতালির বহুমাত্রিক দেনার দায় এবং জার্মানির মূল্য সংকোচন প্রবণতার মতো ইউরোপের মৌলিক সমস্যাগুলো এ তহবিল সমাধান করতে পারবে না। তবু আপাতত এর চেয়ে ভালো কোনো উদ্ধারের উপায় ইউরোপের সামনে নেই।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ফিলিপ্পে লেগারিন: ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্টের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা