একলার ঈদ, একাকিত্বের ঈদ

সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে এই সব দিনে। ঈদে, উৎসবে, ছুটির একটুখানি অবকাশে। মনে পড়ে শিশিরে রোদপড়া মুক্তো ছড়ানো সবুজ মাঠ, সারা রাত টিনের চালে বিষণ্ন শিশিরের শব্দ। ভাইবোন মিলে একটা বাসায় গাদাগাদি গলাগলি করে বড় হওয়ার দিন। পায়ে কাঁটা বিঁধত প্রায়ই, খালি পায়ে দৌড়াতাম মাঠে। বোন সুই দিয়ে তুলে দিতেন পায়ের কাঁটা। বের করা কাঁটা চোর না ডাকু, তারও টেস্ট ছিল, চোখের পাপড়ি দিয়ে কাঁটা আটকানো গেলে চোর, না হলে ডাকু। চোখে কুটো পড়লে মায়ের কাছে যাওয়া, আম্মা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ থেকে কুটো বের করে দিতেন। আর চোখে ব্যথা লাগলে আম্মা কিংবা বোন একটা রুমালে মুখের ভাপ দিতেন, তারপর সেই ভাপ-গরম রুমাল ঠেসে ধরতেন চোখে।

প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাব, আম্মা আমার থুতনি ধরে তেলমাখা চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন। আব্বার কাছে ছুটে যেতাম ছোটবেলায়, দশ পয়সা দিতেন পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে, জোড়া পাঁপড় দশ পয়সা, সিঙ্গেল পাঁপড় পাঁচ পয়সা। আর যদি চার আনা পেতাম, তাহলে নারকেল দেওয়া মালাই আইসক্রিম। প্রায়ই জ্বর হতো, সাগু বা বার্লি নামের অত্যাচার গিলতে হতো, আম্মা বালিশের ওপরে অয়েল ক্লথ বিছিয়ে বালতি থেকে বদনায় পানি তুলে মাথায় ঢালতেন। পাঁচ ভাইবোনের লাইন করে জ্বর আসত। 

বাড়িতে আত্মীয়স্বজন মিলে ১০–১২ জন, একটা মুরগি ১২ টুকরা করতে হতো। ঈদ মানে ছিল অসহ্য আনন্দের প্রতীক্ষা। দুদিন পরে ঈদ। রোজার ঈদে সেমাইয়ের মেশিনের হাতল ঘুরিয়ে সেমাই বানানো চলত। আমার কাজ ছিল ছাদে উঠে বড় পাটখড়ি দিয়ে শুকাতে দেওয়া সেমাই থেকে পাখি তাড়ানো। একটা পাটখড়ির গায়ে কাগজের চোঙ লাগিয়ে মাইক বানিয়ে তার টেনে দেশলাইয়ের প্যাকেটকে মাউথপিস করে সারা দুপুর আবৃত্তি করতাম নজরুলের কবিতা—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’। মেজ ভাই বলতেন, রোজার ঈদের একটা সান্ত্বনা আছে, এই ঈদ চলে গেলে দুই মাস পরেই আসে কোরবানির ঈদ। কোরবানির ঈদ চলে গেলে আর সান্ত্বনা নেই—পুরো দশ মাস অপেক্ষা।

ঈদে নতুন জামাকাপড় পেতাম না বললেই চলে। কিন্তু অনাবিল আনন্দের দিনরাত্রি পার করতাম। আরেকটু বড় হলে রংপুরে গেল টিভি কেন্দ্র, আমাদের ঈদের রাত আনন্দে ভরিয়ে দিত ঈদের নাটক, আর আনন্দমেলা। কোরবানির ঈদের গরু, রংপুরে লালবাগের হাট থেকে কেনা হবে, নাকি হবে নিশবেতগঞ্জের হাট থেকে, এটা ছিল পারিবারিক বৈঠকের আলোচ্য। গোটা গরু ছোটবেলায় আমরা কোরবানি কমই দিয়েছি। আরেকটু বড় হলাম। পড়াশোনা করতে চলে এলাম ঢাকায়।

আব্বা মারা গেলেন, আমি তখন বুয়েটের ফার্স্ট ইয়ারে। ঈদ মানে আমরা সব ভাইবোন রংপুরে যাব, একখানে হব, এটাই ছিল মূল আকর্ষণ। কোনোবার রংপুরে যেতে না পারলে মন খুব খারাপ হতো। একবার ঈদের দিন কোরবানির পর গাড়ি করে রংপুরে গিয়েছিলাম। আরেকবার গিয়েছিলাম ঈদের রাতে, বাসে। রাত দশটায় বাস ছাড়ল, রাত দুইটায় কন্ডাক্টর বলে, নামেন। কী ব্যাপার? রংপুর এসে গেছে। মধ্যরাতে কামিনী ফুলের গন্ধ ছাওয়া কটকিপাড়ার রাস্তা ধরে বাসার সামনে গিয়ে কড়া নাড়া—আম্মা, এসেছি!

আম্মা আমাদের সবাইকে পেয়ে কী যে করবেন বুঝে উঠতেন না। ঈদের নামাজ পড়ে আমরা যেতাম মুন্সিপাড়া কবরস্থানে, আব্বার কবর জিয়ারত করতে। ঈদের সন্ধ্যায় আমাদের ছেলেমেয়েরা আয়োজন করত আনন্দমেলা। তাতে প্রতিযোগিতা শেষে পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকত। কে পুরস্কার জিতবে, এই নিয়ে চোখের পানি ফেলাও চলত ছোটদের। আসার আগে আম্মা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গরুর ভুঁড়িটা না খেয়ে যেন আমরা না বের হই। আমার প্রিয় পুঁটিমাছ তো থাকতই। তারপর এক এক করে পাঁচ ছেলেমেয়ে বিদায় নিত। আম্মা একা!

সেই একলা হওয়ার দিন আমার জীবনেও এল। আমার মেয়ে পড়তে প্রথমে গেল ভারতের পুনে, পরে আমেরিকা! আম্মাকে বলতাম, আম্মা, আমি এক মেয়ে ছাড়া থাকতে পারি না, আপনি এতজন ছেলেমেয়েকে ছাড়া কেমন করে থাকেন। আম্মা বলতেন, প্রথম প্রথম খারাপ লাগে, তারপর সহ্য হয়ে যায়।

দুই বছর আগে আম্মাও মারা গেলেন। রংপুরে, মুন্সিপাড়া কবরস্থানে আম্মা, আমাদের বড় আম্মা আর আব্বার কবর পাশাপাশি।

আগে আমরা করতাম জীবনযাপন! এখন করি দিনযাপন! তার ওপরে করোনা! ঢাকায় পাশাপাশি থাকি ভাইবোনেরা, আত্মীয়স্বজন। তবু কেউ কারও সঙ্গে দেখা যে করতে যাব, করোনাকালে সে উপায়ও নেই। এখন ইন্টারনেট ভরসা, গ্রুপকল, জুম বৈঠক। এর মধ্যে কত মানুষ বেকার, কতজন ঢাকার বাসা ছেড়ে চলে গেল গ্রামে! শহরে কেউ নেই, কিছু নেই, গ্রামে অন্তত মা আছে, মাটি আছে, মারা গেলে মাটিটা জুটবে। আম্পান যেতে না–যেতেই এসেছে বন্যা!

উৎসব মানে মিলিত হওয়া। কোরবানির ঈদ হলো ত্যাগের ঈদ। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ঈদ। ভাগ্যিস, একটা জনপদের বেশির ভাগ মানুষ ভালো। এবং একটা খারাপ মানুষও সব সময় খারাপ নয়, বেশির ভাগ সময় ভালো। যে দেশে করোনা টেস্টের নামে প্রতারণা হয়, ওষুধে ভেজাল দেওয়া হয়, তুষ দিয়ে মসলা বানানো হয়, সেই দেশেই তো বিদ্যানন্দের বাচ্চারা মানুষের পাশে দাঁড়ায়, মাস্তুলের তরুণেরা দাফনকাফন করে, আল মারকাজুল মৃতের পাশে দাঁড়ায়, মানুষ প্লাজমা দান করে, পুলিশ সদস্য নিজে ভ্যান চালিয়ে করোনা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়!

কোরবানি ঈদ আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়। নিজের লোভের পশুর লকলক করা দুর্নীতির জিবটাকে দমন করতে পারলেই না আমাদের ঈদ পালন অর্থবহ হতো!


ঈদের আগে এমন একটা মন খারাপ করা লেখা! বরং কৌতুক বলি!

একজন উকিল ট্রেনে উঠেছেন। এই বগিটা মোটামুটি ফাঁকা। প্রতারক চক্রের সদস্য একজন নারী উঠলেন সেই কামরায়। উকিলকে বললেন, ‘আপনার কাছে যা যা আছে, সব আমাকে দিয়ে দিন। না হলে চিৎকার করব। আশপাশের লোকেরা চলে আসবে, পুলিশ আসবে। আপনার মান–সম্মান যাবে। আপনাকে অ্যারেস্ট করা হবে।’

উকিল কানে দেখিয়ে ইঙ্গিত করলেন, তিনি কিছু শোনেন না। একটা কাগজ–কলম এগিয়ে দিয়ে লিখলেন, ‘যা বলার লিখে বলুন। আমি কানে শুনি না।’

মহিলা লিখলেন, ‘যা আছে সব দিন। তা না হলে আমি চিৎকার করে বলব, আপনি আমাকে অপমান করেছেন।’

উকিল কাগজটা সামলে রেখে বললেন, ‘এবার আমি লোক ডাকব, পুলিশ ডাকব।’

মুখের কথার কোনো দাম নেই। আমি একবার সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলাম, প্রথম দিন অভিজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছিল, ওপরওয়ালা যখন মুখে নির্দেশ দেবে, তখন তুমি সেটা কাগজে লিখে তার কাছে পাঠাবে: ‘আপনার মৌখিক নির্দেশ এইরূপ। আমি কি অগ্রসর হব?’

সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ে এ ওকে, ও একে দোষারোপ করছেন। তাঁদের উদ্দেশে আমি এই পরামর্শ দিয়ে রাখলাম।


একা একা ঈদের নামাজ পড়তে হবে। আমি মনে করি, ঢাকা এখনো করোনার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমি দুজন নিকটাত্মীয়কে হারিয়েছি করোনায়। খুবই আপন দুজন মাসখানেক ভীষণ ভুগে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। কত প্রিয়জনকে হারালাম, আনিসুজ্জামান স্যার থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষাসচিব!
এই সময় মনে হয়:
ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে—
কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে।
এই দুঃসময়ে এসেছে ঈদ। এবারের ঈদ আমাদের আরও একলা করে তুলেছে। বহুত্বের মধ্যে মুক্তি খুঁজে নিতে যদি পারি, তবে হয়তো চরিতার্থতা মিলবে। আপন কোণের বাইরে চাইতে হবে। উৎসব মানে যে মিলন।
আসুক করোনামুক্ত দিন। দুর্নীতির ভাইরাসমুক্ত দিন। মানবাধিকারের ভ্যাকসিনযুক্ত দিন।
ঈদ মোবারক!

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক