ঘাস কাটার কাঁচি চুরির শাস্তি যখন যাবজ্জীবন

ঘটনাটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা অঙ্গরাজ্যে। রায়টিও লুইসিয়ানা সুপ্রিম কোর্টের। ফেয়ার ওয়েন ব্রায়ান্ট, একজন কৃষ্ণাঙ্গ, যাঁর বর্তমান বয়স ৬২ বছর। গত সপ্তাহে ঘাস কাটার তিনটি বড় কাঁচি চুরি করার ‘চেষ্টার’ অপরাধে তাঁর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি লুইসিয়ানা সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই রায় নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা। আলোচনা বা সমালোচনা কেনইবা নয়—উল্টো প্রশ্নও ছুড়ে দেওয়া যেতে পারে।

লুইসিয়ানায় আমেরিকান কালো মানুষদের ইতিহাস অনেক পুরোনো এবং ঐতিহাসিক। কুয়েন্টিন টারান্টিনো পরিচালিত বিখ্যাত হলিউড মুভি ‘জ্যাঙ্গো-আনচেইনড’–এও এই লুইসিয়ানার কালো মানুষদের দিনযাপন, কৃষিতে তাঁদের শ্রম, তাঁদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং সাদাদের সঙ্গে তাঁদের প্রতিনিয়ত লড়াইয়ের চিত্র ফুটে উঠেছিল।

লুইসিয়ানা সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এ রায় এরই মধ্যে সারা বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, কেনইবা একজন কৃষ্ণাঙ্গ অপরাধীর যাবজ্জীবন সাজা নিয়ে এত আলোচনা। কারণ তো আছেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো ঘটনাটি আমেরিকার লুইসিয়ানা অঙ্গরাজ্যের, যাবজ্জীবন হওয়া মানুষটি একজন কৃষ্ণাঙ্গ, বয়স ৬২, যিনি ৩৮ বছর বয়সে গ্রেপ্তার হয়ে ইতিমধ্যে ২৩ বছর জেল খেটেছেন। তাঁর অপরাধ, কৃষিকাজে ব্যবহৃত সামান্য ১০০ ডলার মূল্যের কয়েকটি বড় কাঁচি চুরির চেষ্টা। বিচারকদের মধ্যে ভিন্নমতদাতা বা এই শাস্তির বিপক্ষে মত দেওয়া বিচারকও একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং নারী। বাকি পাঁচ বিচারপতি, যাঁরা যাবজ্জীবনের পক্ষে রায় দেন, তাঁরা সবাই শ্বেতাঙ্গ এবং পুরুষ। রায়টি এমন এক সময় এল, যখন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে চলছে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন।

নথিপত্রে দেখা যায়, সাজাপ্রাপ্ত ব্রায়ান্ট এই চুরির চেষ্টা করেছিলেন ১৯৯৭ সালে। এর আগেও তিনি ১৯৭৯, ১৯৮৭, ১৯৮৯ ও ১৯৯২ সালে এমন কিছু ডাকাতি, চেক প্রতারণা ও চুরির ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, যেগুলোর সব কটিতে তাঁর শাস্তি হয়। লুইসিয়ানার ‘হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার’ আইনে এসব ঘটনার শাস্তি এক করে যোগ করলে তাঁর যাবজ্জীবন শাস্তি মোটামুটিভাবে আইন–সমর্থিত বলাই যায়। লুইসিয়ানার স্টেট লেজিসলেচারের ‘হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার’ আইনের ধারা ৫২৯-১–এর আওতায় এই শাস্তি দেওয়া হয়।

কিন্তু ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে, যখন লুইসিয়ানা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বার্নেট জনসন এই রায়ে ভিন্নমত পোষণ করে বসলেন এবং লিখিত রুলিং দিলেন। বার্নেট একাধারে একজন আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ও নারী এবং ওই কোর্টের প্রথম প্রধান আফ্রিকান-আমেরিকান নারী বিচারপতি। তিনি বললেন, ‘ওয়েন ব্রায়ান্ট এরই মধ্যে ২৩ বছর সাজা খেটেছেন। তাঁকে খাওয়াতে, পরাতে এবং সুস্থ রাখতে করদাতা নাগরিকদের পকেট থেকে গেছে ৫ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৭ মার্কিন ডলার। যদি তিনি আরও ২০ বছর বাঁচেন, তাহলে লুইসিয়ানার করদাতাদের আরও ১০ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করতে হবে এই অপরাধীকে তাঁর “শাস্তি” ভোগ করাতে।’

এ তো গেল আধুনিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন ‘সামান্য অপরাধের’ অপরাধীকে জেলে পুরে করদাতাদের পকেট কাটার একটি দিক। এবার জনসন তাঁর কলম তাক করলেন অন্য একটি বিষয়ে। তা আরও মারাত্মক! তিনি হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার আইনের আওতায় দেওয়া এই শাস্তিকে বহু পুরোনো ‘পিগ-লজ’–এর সঙ্গে তুলনা করে বসলেন। পিগ-লজ সম্পর্কে একটু না বললেই নয়, এটি মূলত আমেরিকায় ১৯০৯ সালে ভ্যাগরেন্সি আইন উদ্ভূত একটি পরিভাষা, যেখানে পুলিশ কর্মকর্তাদের অসীম ক্ষমতা দেওয়া ছিল খামারের প্রাণী চুরির অপরাধে যে–কাউকেই গ্রেপ্তার করে কঠিনতর শাস্তির মুখোমুখি করতে। আর তখন খামারে মূলত কাজ করতেন দাসত্বমুক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, পিগ-লজ মূলত করা হয়েছিল ফ্রি-আমেরিকান-ব্ল্যাকদের পুনরায় দাসত্বের শিকলে আবদ্ধ করতে। এই জন্য প্রধান বিচারপতি জনসন এই হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার আইনে কাউকে এই রকম ভয়াবহ রকমের দীর্ঘ সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি দেওয়াকে ওই ‘পিগ-লজ’–এর আধুনিক সংস্করণ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর এই আখ্যান যে একেবারেই অমূলক নয়, তা আমরা ‘দ্য গার্ডিয়ান’–এর করা এক জরিপে দেখতে পাই। সেখানে দেখা যায়, লুইসিয়ানা অঙ্গরাজ্যের কারাগারে হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার আইনের আওতায় শাস্তি ভোগরত ৮০ শতাংশ কয়েদিই কালো এবং অপরাধের পেছনে মূল কারণ দারিদ্র্য অথবা মাদক।

জনসন আরও বলেন, ব্রায়ান্টের প্রতিটি অপরাধ হচ্ছে কিছু চুরির ‘চেষ্টা’ করা মাত্র। এই সামান্য ছিঁচকে চুরি মানুষ হয়তো করে দারিদ্র্যের কারণে অসহায় হয়ে অথবা নেশায় পড়ে অথবা দুটো মিলিয়েই। কারও ওপর এমন দারিদ্র্যতাড়িত এবং নেশার পাল্লায় পড়ে করা ফৌজদারি আচরণের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড আরোপ করা আসলে অনেক নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক মনে হয়।

‘মাত্র তিনটি কাঁচি চুরির ব্যর্থ চেষ্টার কারণে একজন অপরাধীর যাবজ্জীবন শাস্তি অপরাধের মাত্রার সঙ্গে কোনোভাবেই আনুপাতিক নয় এবং এমনতর শাস্তি আদতে কোনো বৈধ দণ্ডাদেশ হাসিল করে না।’ জনসন তাঁর লিখিত রায়ে এই গুরুত্ব দেন।

এখানে একটি মজার বিষয় হচ্ছে, আপিলকারী ব্রায়ান্ট মূলত ডিসট্রিক্ট আপিলেট কোর্টের হ্যাবিচুয়াল আইনে দেওয়া তাঁর যাবজ্জীবনের শাস্তিকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করা হোক, তা চেয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর এবং লুইসিয়ানা স্টেট সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২০–এর আওতায় এর একটি সুযোগও ছিল। যেখানে অস্বাভাবিক, নিষ্ঠুর, ও অতিমাত্রার শাস্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি যুগান্তকারী জুডিশিয়াল রিভিউয়েরও সুযোগ ছিল। কিন্তু ৫:১–এ হেরে গিয়ে ব্রায়ান্টের শেষ আশাটুকুও আর থাকল না। উল্লেখ্য, ওই পাঁচ সাদা-পুরুষ বিচারকের কেউই তাঁদের রায়ের পক্ষে কোনো লিখিত রুলিং দেননি, আর আরেকজন প্যানেলে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেন। যেহেতু হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার আইনটি একটি স্টেট লেজিসলেচার, তাই মোটামুটিভাবে বলা যায়, এই রায়ের বিরুদ্ধে ব্রায়ান্টের ইউএস সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ খুবই কম। কারণ, স্টেট লেজিসলেচারের বেলায় স্টেট সুপ্রিম কোর্টের রায়ই চূড়ান্ত। সাধারণত ফেডারেল ইস্যুগুলো ইউএস সুপ্রিম কোর্টে যায়।

অনেক খেলা বা যুদ্ধ থাকে, যেখানে প্রতিপক্ষ এক নিমেষেই হেরে গেলেও রেখে যায় কিছু ইতিহাস, কিছু ভাবনার খোরাক, যার ওপর ভর করে হয়তো ভবিষ্যতে জিতে যায় সেই হেরে যাওয়া পক্ষের অনুজেরা। এই রায় ঠিক তেমনই একটি রায়। এখানে বিচারপতি জনসনের একক লড়াই বা ব্রায়ান্টের আপিল ৫:১–এ হেরে গেলেও এই রায়ের গর্ভে এমন অনেক কিছু আছে, যা আইন অঙ্গনে অনেক দিন ধরে চিন্তার খোরাক হিসেবে কাজ করবে। খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রধান বিচারপতি জনসন ছাড়া বাকি পাঁচ শ্বেতাঙ্গ বিচারপতির কেউই লিখিত রুলিং প্রকাশ করেননি। এই পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ বিচারপতি এই রায়ে আইনের আক্ষরিক ব্যাখ্যা এবং অপরাধের উপাদান ও অপরাধীর অভিপ্রায়কে বেশি গুরুত্ব দেন, অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি জনসন দেখান, অপরাধের মাত্রার সঙ্গে শাস্তির পরিমাণ আনুপাতিক নয়। তিনি দেন ‘গোল্ডেন ইন্টারপ্রিটেশন অব ল’ এবং অপরাধের পেছনের মোটিভকে দেন বেশি গুরুত্ব। তিনি হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার আইনে পেলেন আধুনিক যুগে ব্ল্যাক আমেরিকানদের দাস বানানোর উপকরণ। এই আইনের আওতায় কেউ সামান্য অপরাধ করলেও তাকে আজীবন বা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জেলে রাখা যায়, যা লুইসিয়ানার সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২০–এর মারাত্মক ব্যত্যয়। প্রধান বিচারপতি জনসনের এই ভিন্নমতাবলম্বী রুলিং ওই অঙ্গরাজ্যের সাংবিধানিক সংকটের দিকে আমাদের দৃষ্টিপাত করায়।

তবে কিছুটা বাইরের, কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় হলো, এই প্রধান বিচারপতি জনসনকে ফেডারেল ডিসট্রিক্ট কোর্টে তাঁর জ্যেষ্ঠতা প্রমাণ করার জন্য মামলা করে সেই মামলা জিতে প্রধান বিচারপতি হতে হয়েছিল। এই ২০২০ সাল শেষে প্রধান বিচারপতি জনসন আর নির্বাচনে দাঁড়াবেন না বলে জানান। যাবজ্জীবনের পক্ষে মত দেওয়া আরেক বিচারপতি উইমার হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রধান বিচারপতি। তিনি কার্যভার গ্রহণ করবেন ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি।

হয়তো কোনো এক দিন এই রায় নিয়ে অনেক আলোচনা হবে, মামলার ঘটনা নিয়ে মুভি তৈরি হবে, ল জার্নালে আর্টিকেল লেখা হবে। তবে যা–ই করা হোক না কেন, ফেয়ার ওয়েন ব্রায়ান্টের সঙ্গে যা হলো, তা যে অনেক ‘ফেয়ার’ হলো, তা কিন্তু কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না। কারণ, আইনে ‘ফেয়ারনেস’ শব্দটি সুন্দরতম একটি শব্দ।

শেখ মো. মুহিব্বুল্লাহ: বিচারক, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস।