যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এখনো নিজেদের সামলাতে পারে

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: রয়টার্স

চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পর্যবেক্ষণকারীদের আলোচনায় নতুন এক শীতল যুদ্ধের প্রসঙ্গ বারবার আসছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ দিন দিনই স্পষ্ট হচ্ছে। বাণিজ্যযুদ্ধ ছাড়াও দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে একের পর এক বিধ্বংসী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে, পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা হিসেবে পরস্পরের কনস্যুলেট বন্ধ করে দিয়েছে, দুই দেশের কর্মকর্তারা পরস্পরের প্রতি বিষোদ্‌গার করে বক্তৃতা দিচ্ছেন।

দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার জের ধরে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতিকে বিযুক্ত করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শীতল যুদ্ধ পূর্ণ মাত্রায় শুরু হলে শুধু এই দুটি দেশ নয়, গোটা বিশ্ব অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যাবে। আঞ্চলিক সংকট শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক সংকটে রূপ নেবে।

ভালো খবর হলো এ ধরনের পরিস্থিতি এখনই ঘটতে যাচ্ছে না। আর খারাপ খবর হলো কয়েক মাস আগেও শীতল যুদ্ধের আশঙ্কা যতটুকু ছিল, এখন তার চেয়ে বহু গুণ বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চেয়ে খারাপ খবর হলো দুই দেশের মধ্যে সামরিক যুদ্ধের আশঙ্কাও প্রকট হয়ে উঠছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা হলো কেন? অনেকে বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে তা অনিবার্যই ছিল, কারণ প্রতিষ্ঠিত শক্তির সামনে উদীয়মান শক্তি দাঁড়ানোর সময় কখনোই সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয় না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে গত কয়েক মাসে চীন সরকার নিজ দেশে এবং বিদেশে আক্রমণাত্মক আচরণ করা শুরু করেছে। নিরাপত্তা আইন পাস করে হংকংয়ের নিয়ন্ত্রণ আরও কড়াভাবে গ্রহণ করা, উইঘুর মুসলমানদের ওপর অমানবিক আচরণ করা, ভারতসংলগ্ন সীমান্তে ভারতীয় সেনাদের ওপর হামলা করা, দক্ষিণ চীন সাগরে ভিয়েতনামের জাহাজডুবি, তাইওয়ান ও সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জে চীনের শক্তি প্রদর্শন—এসবের মাধ্যমে চীনের আক্রমণাত্মক মনোভাব ফুটে উঠেছে। আর এতেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই মনে করা শুরু করেছে চীন তার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হরণ করছে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থানের বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সামরিক শক্তি বাড়িয়ে মার্কিন প্রভাব–প্রতিপত্তিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে চীন এখন কেন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল?

হয়তো এমন হতে পারে, কোভিড-১৯–এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সামলাতে যখন ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়টাকে শক্তি প্রদর্শনের মোক্ষম সময় হিসেবে সি চিন পিং বেছে নিতে পারেন। আবার এমনও হতে পারে, কোভিড-১৯–এর কারণে চীনের ভেতরে যে অস্থিরতা চলছে, তা থেকে বাইরের বিশ্বের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখার জন্য চিন পিং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেন।

তৃতীয় সম্ভাব্য কারণটি ভয়ানক। কারণটি হলো, হয়তো চীন তার আগের ‘ধীরেসুস্থে চলো’ এবং ‘প্রদর্শন এড়িয়ে নীরবে ক্ষমতা বাড়াও’ নীতি থেকে সরে এসেছে এবং ক্রমবর্ধমান শক্তির জোরে সে এখন আগ্রাসনের অভিলাষ চরিতার্থ করতে চাইছে। যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে, তাহলে শীতল যুদ্ধ তো বটেই, সরাসরি সামরিক যুদ্ধও অবধারিত।

যে মুহূর্তে এসব ঘটছে, ঠিক সে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চলছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন কোভিড-১৯ মহামারি সামাল দেওয়া থেকে সবার নজর ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া ট্রাম্প নিজেকে জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করতে চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এটি চীনকে আরও মারমুখী আচরণের উসকানি দিচ্ছে। আগামী নির্বাচনে যদি জো বাইডেন নির্বাচিত হন, তাহলেও যে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে, এমনটা আশা করা যায় না।

তবে যে মহামারি এ দুই দেশের দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করেছে, সেই মহামারিই তাদের সম্পর্ককে স্বাভাবিক করে তুলতে পারে। কোভিড-১৯–এর চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে দুই দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের বরফ গলানোর শুরুটা করা যেতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

রিচার্ড হাস: কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট