হিন্দি সিনেমা যে ভারতের ছবি দেখায়

তিনটি সাম্প্রতিক ভারতীয় সিনেমার পোস্টার।

ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা আমির খানের ‘পিকে’ ছবিটা নিয়ে বেশ শোরগোল হয়েছিল। ছবিটিতে ভণ্ড সাধু-সন্ন্যাসীদের অপকর্ম তুলে ধরা হয়। একশ্রেণির দর্শকের অভিযোগ, আমির খানের ছবিতে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের কর্মকাণ্ড যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, মুসলমান সমাজের ভণ্ড ফকির-দরবেশদের কথা সে অনুপাতে দেখানো হয়নি। নানাভাবে জল ঘোলা হলো বটে, ছবিটা কিন্তু দর্শকসমাদৃত ও ব্যবসাসফল। বলিউডের আরেক জনপ্রিয় ‘খান’ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করলেন অন্যভাবে। ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ ছবিতে ধর্মপ্রাণ (হিন্দুধর্মাবলম্বী) এক তরুণকে দেখালেন। এই তরুণ মনের দিক থেকে এতই উদার যে পাকিস্তান থেকে দৈবক্রমে ভারতে চলে আসা এক মুসলমান কিশোরীকে জীবনবাজি রেখে তার দেশ পাকিস্তানে মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসেন। লোকজন সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। এই জনপ্রিয় ছবিগুলোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করলাম দর্শকমনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য। হিন্দি সিনেমার বিশাল এক দর্শকগোষ্ঠী আছে ভারতজুড়ে (ভারতের বাইরেও হিন্দি ছবির দর্শকসংখ্যা কম নয়)। এই দর্শক ঠিক কী চায়, তার জরিপও নিশ্চয় আছে নির্মাতা বা প্রযোজকদের কাছে। কেননা, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের সঙ্গে দর্শক কী ‘খাবে’, এই প্রশ্নটা গভীরভাবে সম্পর্কিত।

একসময় ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’র মতো সর্বধর্ম সমন্বয়ের ছবি হয়েছে ভারতে। চলচ্চিত্র নির্মাতারা বারবার বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে, বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রীতির বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন। এসব ছবি সমাদৃত ও ব্যবসাসফল হয়েছে। হিন্দি ছবির আমদর্শকের মনস্তত্ত্ব তো সমাজ-মানসেরও প্রতিফলন। তাই বিভিন্ন অঞ্চলে যত সাম্প্রদায়িক সংঘাত সংঘর্ষই হোক, মোটাদাগে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে হবে, এমন একটা বার্তা সমাজ থেকেই উঠে এসেছে বারবার। বড় বড় রাজনৈতিক দল ও নেতাকেও তাই অন্তরের বিশ্বাস থেকেই হোক বা মনভেজানো বুলি হিসেবেই হোক, জনসমক্ষে উচ্চারণ করতে হয়েছে সম্প্রীতির কথা। শিবসেনা, হিন্দু মহাসভা বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলো রাখঢাক না রেখে হিন্দুত্বের মন্ত্র আউড়ে গেছে বলেই হয়তো সর্বভারতীয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি।

কিন্তু গত কয়েক বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে ভারতীয় রাজনীতিতে। মোদির বিজেপি সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর দেশকে ‘রামরাজত্বে’ পরিণত করার কৌশল বা পরিকল্পনা আর আবছা থাকছে না। সংবিধানে কাশ্মীরের জন্য বিশেষ মর্যাদার ৩৭০ ধারা বাতিল করা আর সেই মর্যাদাহানির বর্ষপূর্তির দিনটিতেই অযোধ্যায় ভূমিপূজার মাধ্যমে রামমন্দির নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এতে তাঁর দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট।

দুর্নীতি ও বেকারত্ব দূর করা আর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদি। কিন্তু নোটবন্দীর মতো কিছু স্থূল পদক্ষেপ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু করতে তো পারেনইনি, উপরন্তু তাঁর নিজের দলের লোকজনের দুর্নীতি-সম্পৃক্ততা ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত। কর্মসংস্থান হয়নি লাখ লাখ বেকার তরুণ-যুবকের। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ফাঁপা বুলির মতো প্রতিধ্বনিত হয়েছে বিশাল দেশটির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। কিন্তু তারপরও কী করে দ্বিতীয় দফায় দেশ পরিচালনার ম্যান্ডেট পেলেন মোদি ও তাঁর দল বিজেপি?

সোজা উত্তর, তাঁর যাবতীয় ব্যর্থতা ঢেকে দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। দীর্ঘদিন এই দাওয়াইটা বাজারজাত করতে সমর্থ হয়েছে বিজেপি। বিরোধী দল কংগ্রেস কাশ্মীরের ব্যাপারে মিনমিন করে প্রতিবাদ জানালেও রামমন্দিরের ব্যাপারে উল্টো সমর্থন জানাতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৮৬ সালে অযোধ্যায় রামমন্দিরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন খোদ কংগ্রেস নেতা প্রয়াত রাজীব গান্ধী। সেই ক্ষুদ্র বীজটি আজ বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।

আবার হিন্দি ছবি প্রসঙ্গে আসি। আগেই বলেছি, সমাজমনস্তত্ত্বের প্রতিফলন যেমন চলচ্চিত্রে উঠে আসে, আবার সেই মানসকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও এখানে দুর্লক্ষ্য নয়। অতিমারির সময়টাতে বেশ কিছু হিন্দি ছবি দেখার সুযোগ হলো। ছবিগুলো দেখে ভারতের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরম্পরাও কিছুটা আঁচ করা সম্ভব। এই সময়ে নির্মিত ছবিগুলোর বড় অংশ দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি ধারা ঐতিহাসিক কাহিনির প্রেক্ষাপটে হিন্দু জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত (মণিকর্ণিকা, তানাজি: আ আনসাং হিরো প্রভৃতি), অন্য ধারাটি জঙ্গি ও পাকিস্তানবিরোধী সেনা ও গোয়েন্দা তৎপরতার সাফল্যখচিত (উরি: আ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বেবি, স্পেশাল ২৬, সুপার থার্টি, রাজি প্রভৃতি)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ‘পদ্মাবতী’ ছবিটি নির্মাণকালে শুটিং লোকেশনে হামলা, সেট জ্বালিয়ে দেওয়াসহ অনেক রকম ঘটনা ঘটেছিল। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কারণে ঐতিহাসিক সত্যকে সম্পাদনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন পরিচালক। এমনকি ছবির নামও পরিবর্তন করে ‘পদ্মাবত’ করা হয়েছিল। ‘পদ্মাবত’, ‘মণিকর্ণিকা’ বা ‘তানাজি’র কাহিনিতে ইতিহাসস্বীকৃত পরাজয়ের গ্লানির চেয়ে বড় করে তোলা হয়েছে আত্মদানের বীরত্ব। এটা শুধু সান্ত্বনা নয়, শ্লাঘা বোধ করারও একটা ক্ষেত্র।

জঙ্গিবিরোধী ও পাকিস্তানবিরোধী অভিযানে ভারতীয় সেনাদের সাফল্য নিয়ে কাহিনিগুলোতেও প্রকারান্তরে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উসকে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, অজয় দেবগনসহ বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র তারকা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা পাকিস্তানবিরোধী উসকানি আছে—এমন ছবিতে অভিনয় করবেন না। তখন এ রকম ঘোষণা দেওয়ার মত সুযোগ সমাজে ছিল। কিন্তু মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে হামলাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের হামলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর সেই মুখ আর তাঁদের নেই। ইতিবাচক দিক হিসেবে শুধু এটুকুই দেখা যায়, চলচ্চিত্রের কাহিনিতে জঙ্গি ও পাকিস্তানবিরোধী অভিযানে মুসলমান সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্ব বা মুসলমানদের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরার মতো সংবেদনশীলতা নির্মাতারা এখনো দেখাতে পারছেন।

চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু সমাজমানসকে প্রভাবিত করছে, না সমাজ বাস্তবতার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে চলচ্চিত্রের কাহিনি, সেটা নিশ্চয় গবেষণার বিষয়। কিন্তু শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা এবং সাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচিত বাল ঠাকরের বায়োপিক নির্মাণ করে তাঁর কর্মকাণ্ডকে সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রয়াস থেকেই বোঝা যায়, কীভাবে বিজেপির লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রস্তুত হয়েছে সমাজ!

৫ আগস্ট অযোধ্যায় ভূমিপূজার মাধ্যমে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘এই মন্দির হবে ভারতীয় সংস্কৃতির আধুনিকতম প্রতীক। রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতিফলন ঘটবে এর মধ্য দিয়ে।’ দ্বিধাহীন ভাষায় তিনি জানালেন, ভক্তদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসেবে শুধু নয়, ‘রাষ্ট্রীয় ভাবনার’ প্রতিফলন হিসেবেও স্বীকৃতি পাচ্ছে এই মন্দির। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সমাধিস্থল হিসেবেই সাড়ে ২২ কেজি ওজনের রুপার ইট প্রোথিত হয়েছে এখানে।

জানি না শেষ পর্যন্ত মোদির অভিপ্রায়ই পূর্ণ হবে, না ইতিহাস ফিরবে সম্প্রীতির ধারায়। হিন্দি জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্র কি ফিরতে পারবে ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’র কাহিনিতে?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক