বাংলাদেশটা যদি বরিশাল হতো!

৬ এপ্রিল বিভাগীয় বইমেলা উপলক্ষে বরিশালে গিয়েছিলাম। এতে সব মিলিয়ে ৬৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়। ৩ এপ্রিল মেলা উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মেলায় প্রতিদিনই আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন চলছে, যাতে বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে। চলবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। একটি বইমেলায় কত বই বিক্রি হলো, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বই সম্পর্কে পাঠককে আগ্রহী করে তোলা। কালেভদ্রে নয়, প্রতিবছরই জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে মেলার আয়োজন হওয়া উচিত।
খুব ভোরে লঞ্চযোগে বরিশালে পৌঁছেই কিছুটা অবাক হলাম। রাস্তাঘাট সব পরিষ্কার। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘বাংলার ভেনিস’ না হলেও বরিশাল শহরটি এখন বেশ পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। নদীর পাড় ঘেঁষে সবুজের বেষ্টনী। পামগাছের সারি। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। বরিশালের শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী—যাঁদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন, শহরটির এই পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরির কৃতিত্ব সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের, যিনি বর্তমানে ঢাকার একটি হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাঁরা বললেন, হিরনের আমলেই শহরে বেশির ভাগ উন্নয়নকাজ হয়েছে। দখলদারদের আগ্রাসন থেকে বিবির পুকুরসহ অনেক সরকারি সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
সকালে সদর রোডের এক রেস্তোরাঁয় নাশতা করতে গিয়ে আলাপ হয় স্থানীয় কয়েকজন পেশাজীবীর সঙ্গে। সেখানে কিশোর বয়সী এক হকার ছিল, নাম রতন। জিজ্ঞেস করি, কোন পত্রিকা এখানে বেশি চলে? রতন বলল, প্রথম আলো ও যুগান্তর। সে কোন পত্রিকা কটি বিক্রি করে? তার জবাব: প্রথম আলো ৬০টি ও যুগান্তর ৩২টি। রেস্তোরাঁর মালিক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঢাকার খবর কী?’ সাতসকালে ঢাকার খবর? আমি কৌতূহল প্রকাশ করলে তিনি জানান, ‘আমি জানতে চাইছি, অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হিরন সাহেবের কোনো খবর আছে কি না?’
দুপুরে আদালতপাড়ায় কথা হয় বরিশাল বারের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে। জানতে চাই, বরিশালের রাজনীতি কেমন চলছে? জবাবে তাঁদের একজন বললেন, মোটামুটি ভালো। গত বছর নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দেশজুড়ে হানাহানি, মারামারি হলেও বরিশাল শান্ত ছিল। এখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। কেউ মারা যায়নি। জানতে চাই, এখানে কি বিরোধী দলের কোনো তৎপরতা ছিল না? তাঁরা জানালেন, বিরোধী দল শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের বলা হতো, নির্দিষ্ট এলাকা দিয়েই তাদের মিছিল নিয়ে যেতে হবে। তারা সেটি মেনে চলত। আবার সরকারি দল বা প্রশাসনও তাদের সেই কর্মসূচিতে বাধা দিত না।
তাহলে কি আমরা বলতে পারি, বরিশালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে? একজন আইনজীবী জবাব দিলেন, হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। তবে কত দিন এই ভালো অবস্থা থাকবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। এর কারণ, এখানে আওয়ামী লীগের নেতা শওকত হোসেন হিরন ও বিএনপির নেতা মজিবর রহমান সরোয়ারের মধ্যে একটি অলিখিত সমঝোতা ছিল। তাঁরা কেউ কারও কাজে বাধা দেবেন না।
একবার বিএনপি অফিসে হামলা হলে হিরন ঘটনাস্থলে গিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সমবেদনা জানান। বলেন, ‘যাঁরা হামলা চালিয়েছে, তারা আওয়ামী লীগের কেউ নয়।’ এমনকি সম্প্রতি ঢাকায় হাসপাতালে হিরনকে দেখতে গেছেন বিএনপির নেতা সরোয়ার ও আহসান হাবিব কামাল। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এ ধরনের নজির খুব কম।
জিজ্ঞেস করলাম, হিরন সাহেব এত উন্নতি করলেও কেন সিটি নির্বাচনে পরাজিত হলেন? আরেক আইনজীবী বললেন, মানুষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, হিরনের বিরুদ্ধে নয়। আর মনে রাখতে হবে, বরিশাল সব সময়ই বিএনপির শক্ত ঘাঁটি। ১৯৭৩ সালের পর এখানে আওয়ামী লীগ কোনো নির্বাচনে জেতেনি। এমনকি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের জোয়ারের সময়ও সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার। আগের সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন না। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী সরদার শরফুদ্দিন আহমেদ ছিলেন কিংস পার্টির লোক। নানা ঘাটের জল খেয়ে তিনি এখন বিএনপিতে। ২০১৩ সালের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। তিনি আরও যোগ করলেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপি এলে আওয়ামী লীগ বুঝতে পারত, কত ধানে কত চাল। একতরফা নির্বাচন দিয়ে তো জনপ্রিয়তা যাচাই করা যায় না।
তিনি আরও বললেন, তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, সরকারি উন্নয়নকাজ মানেই কমিশন ভাগাভাগি। আবার উন্নয়নকাজের জন্য যাঁদের বাড়িঘর ভাঙা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাঁরা তো তাঁর বিপক্ষে যাবেনই। তবে ড্রেনেজব্যবস্থার সমালোচনাও করলেন কেউ কেউ। রাস্তার পাশে খোলা ড্রেনে অনেকেই আবর্জনা ফেলে ভরাট করেছে। এটি মাটির নিচে হলেই ভালো হতো।
জিজ্ঞেস করি, আর উপজেলা নির্বাচন? তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ যে আইনজীবী, তিনি জবাব দিলেন, উপজেলা নির্বাচনে তো কাউকে ভোট দিতে হয়নি। সকাল আটটার মধ্যেই সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে সব ভোট দেওয়া হয়ে যায়।
বিএনপি প্রতিবাদ করেনি? না, করেনি। কেননা, তারা বুঝে গেছে, প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হবে না।
আরেকজন বললেন, যে কাজটি এত দিন সামরিক শাসকদের দল করত, তা এবার শেখ হাসিনার দল করল, এটাই দুর্ভাগ্য। উপজেলা নির্বাচনে বিরোধী দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা সাড়ে পাঁচ হাজার নির্বাচন সুষ্ঠু করেছে, ভবিষ্যতে সেই দাবি আর করতে পারবে না।
জিজ্ঞেস করলাম, আওয়ামী লীগের আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর প্রভাব কেমন এখানে? তাঁরা জানান, বরিশালে তাঁর কোনো প্রভাব নেই। তিনি এখানে থাকেনও না। ঢাকা থেকে সোজা আগৈলঝাড়ায় চলে যান।
জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব কেমন? এ প্রশ্নের জবাবে সরকারি বরিশাল কলেজের একজন শিক্ষক জানান, বরিশালে জামায়াতের তেমন প্রভাব বা সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। তবে চরমোনাই পীরের প্রভাব আছে। তাঁর ভক্ত-মুরিদানও কম নন। গত বছর মের আন্দোলনের সময় হেফাজত এখানে বড় সমাবেশ করেছে। কিন্তু গোলযোগ হয়নি।
এই মুহূর্তে বিএনপি কি ভালো অবস্থায় আছে? রাজনৈতিকভাবে ভালো না থাকলেও সাংগঠনিকভাবে ভালো অবস্থায় আছে। সরোয়ার ও কামালের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তা এখন নেই। কামাল মেয়র হলেও সরোয়ারের পরামর্শ নিয়েই কাজ করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংশয় রয়েই গেছে। হিরনের সমর্থকেরা মনে করেন, হাসানাতের জন্যই আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। আর হাসানাতের অনুসারীদের দাবি, হিরনের কারণেই এখানে বিএনপি আশকারা পেয়েছে।
তবে বরিশালের ছাত্রলীগ সম্পর্কে একটি ভয়াবহ একটি তথ্য দিলেন হাসানাত আবদুল্লাহর সমর্থক এক কর্মী। তিনি জানান, এখানে ছাত্রলীগ মানে হোন্ডালীগ। গ্রাম থেকে কেউ এসেই ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে কিস্তিতে একটি হোন্ডা কেনেন। তারপর সেই হোন্ডার টাকা দেওয়ার জন্য নেতাদের কাছে ধরনা দেন কিংবা চাঁদা তোলেন।
ওই কর্মীর দাবি, হিরন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা করতেন। হিরনের এক সমর্থক জানান, হাসানাত সাহেব যাঁদের নিয়ে রাজনীতি করেন, তাঁদের নাম শুনলে মানুষ ভয় পায়। তিনি রাতে এসে বৈঠক করে আবার সকালে চলে যান।
নির্বাচনের পর এখানে সাম্প্রদায়িক উসকানির ঘটনা ঘটেছে কি না? একজন শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী জানান, এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত। শহরে কোনো অঘটন ঘটেনি। কিন্তু এই স্থিতিশীল অবস্থা কত দিন থাকে, বলা কঠিন। কেননা, আওয়ামী লীগেরই কোনো কোনো নেতা ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের জন্য উসকানি দিয়ে থাকেন।
ওই আইনজীবী আরও জানান, আগৈলঝাড়ায় ৫৫ শতাংশ ভোটার হিন্দুধর্মাবলম্বী। তাঁরা চেয়েছিলেন, উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদটি তাঁদের দেওয়া হোক। কিন্তু সেখানে হাসানাতের অনুগত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একজনকে দেওয়া হলো। এ নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ আছে। আগামী নির্বাচনে তাঁরা সমুচিত জবাব দেওয়ারও চেষ্টা করবেন। জিজ্ঞেস করি, সমুচিত জবাব দেওয়ার নির্বাচন আদৌও হবে কি? তিনি বললেন, নির্বাচন তো একদিন হবেই। পাঁচ বছর, দশ বছর পরে হলেও।
সন্ধ্যায় যাই বরিশাল প্রেসক্লাবে। সেখানে সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ হয়। জানতে চাই, বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কেমন চলছে? এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, তেমন তৎপরতা নেই। তবে পয়লা বৈশাখ বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই উদ্যাপিত হবে। উদীচী, খেলাঘরসহ অনেক সংগঠন প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাস্তায়ও বৈশাখী মেলার ব্যানার দেখতে পেলাম।
বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে। বিএনপির রাজনীতি করে বিএনপি। এমনকি জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম কিংবা চরমোনাই পীরের যে রাজনীতি, তা তাঁরা করছেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
ক্ষমতাসীন দল না চাইলে প্রশাসন ও পুলিশও সমঝে চলে। বাড়াবাড়ি করে না। মেয়র হিরন সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই শান্তিপূর্ণ অবস্থা চলছে। তবে কত দিন চলবে, বলা যায় না।
কেবল রাজনীতিতেই বরিশাল এই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তাই নয়। অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বরিশালের সাংবাদিক সমাজও। নব্বইয়ের দশকে খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ঢাকায় প্রথম সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত হলে সারা দেশের সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাবগুলোও ভাগ হয়ে যায়। ব্যতিক্রম বরিশাল। সেখানে একটি ভবন। সাংবাদিক একটিই সংগঠন। তারা কোনো কেন্দ্রীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। বিভিন্ন সময়ে দুই ইউনিয়নের নেতারাই তাঁদের কাছে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে বসেছেন। কিন্তু বরিশালের সাংবাদিকদের এক কথা, ‘আমরা ইউনিয়ন নিয়ে রাজনৈতিক ভাগাভাগি চাই না। আপনারা এক হয়ে আসুন। আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকব।’
দুই দশক ধরে বরিশালের সাংবাদিকেরা ঐক্যের পতাকা সুমন্নত রেখেছেন। তাই বলতে ইচ্ছা হয়, বাংলাদেশটা যদি বরিশাল হতো! যদি সবখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বরিশালের মতো সহাবস্থান নীতি জারি থাকত, তাহলে অনেক হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ এড়ানো যেত। দেশটায় শান্তি আসত।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]