কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কি বাতিল হবে?

১৬ জুলাই ২০১৩ ‘বিশ্বব্যাংক’ এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন এ উদ্যোগ অনুযায়ী বিশ্বে নতুন কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে সংস্থাটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিনিয়োগ করবে না। উচ্চ হারে বায়ুদূষণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অভিযোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বর্ধিত সমালোচনার মুখে বিশ্বব্যাংকের জন্য এটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ মনে হলেও সমালোচকেরা এ উদ্যোগের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সস্তায় বিদ্যুৎ পাওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন।
‘ওয়ার্ল্ড কোল অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রধান নির্বাহী মিলাটন ক্যাটেলিন ফক্স নিউজকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোর সবচেয়ে সস্তায় বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য অধিক ব্যয় করতে বাধ্য করবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘কার্যত বিশ্বব্যাংক ওয়াশিংটন প্রশাসনের কয়লাবিরোধী অবস্থান অনুসরণ করেছে।’ তাঁর মতে, ‘বিশ্বব্যাংক তার মূল কাজ দারিদ্র্য নিরসনে ব্যর্থ হয়ে এখন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো ফ্যাশনদুরস্ত কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।’ গত মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দূষণ ছড়ানো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তাঁর ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন’ বক্তব্য দিয়েছেন। সস্তায় এবং বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের সন্ধান পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে তার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করছে, অপর দিকে নিজেদের উৎপাদিত কয়লা বর্ধিত হারে রপ্তানি করছে। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো আলাদাভাবে মূল্যায়ন করবেন।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের টেকসই উন্নয়নবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট রাচেল কাইটস বলেছেন, ‘আমরা মনে করি যে বিশ্বে অনেক দেশ আগামী ১০ বছরেও বিকল্প (কয়লা ছাড়া) জ্বালানি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না। সে ক্ষেত্রে আমরা মুখ ঘুরিয়ে বলব না যে তাদের বিকল্প জ্বালানি উৎসের জন্য ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে।’ ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতে, পৃথিবীর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বিদ্যুৎশক্তির আওতাবহির্ভূত মানুষের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হলে গ্রিডবহির্ভূত, বিকেন্দ্রীকৃত, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎশক্তির সরবরাহ ব্যবস্থা গড়তে হবে এবং সে জন্য বিনিয়োগ সংস্থান করতে হবে।
অন্যদিকে খ্যাতিমান ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান-এ ১৮ জুলাই ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক দুই দশক আগে জনমতের চাপে বিনিয়োগ থেকে সরে এলেও বড় বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে ফিরে আসছে। স্বতন্ত্র ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন আন ড্যাম’ বলছে, ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে আফ্রিকার কঙ্গো নদীর ওপর ইঙ্গা-১, ২ ও কারিবা বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করলেও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছে। এসব বিনিয়োগ নিকটবর্তী খনি উন্নয়ন কোম্পানি এবং অ্যালুমিনিয়াম পরিশোধন কারখানাগুলোকে লাভবান করলেও স্থানীয় গরিব মানুষের বিদ্যুৎ পাওয়ার স্বপ্ন সামান্যই পূরণ করেছে। কঙ্গো নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে বানানো বড় বড় জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যে মানুষের বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে, নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার ৫০ বছর পরও তাদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সংগ্রাম অব্যাহত আছে। এখন বিশ্বব্যাংক আবার আফ্রিকার কঙ্গো নদীর ওপর ইঙ্গা-৩ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে ১২ বিলিয়ন ডলার এবং জাম্বেসি নদীর ওপর আরও দুটি বিপুল ব্যয়ের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। এই তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুতের সম্ভাব্য ক্রেতা আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের খনি উন্নয়ন কোম্পানি এবং সচ্ছল গ্রাহক।
সর্বজনীন বিদ্যুতের সুবিধা সম্প্রসারণে চিহ্নিত নবায়নযোগ্য ছোট ছোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের আহ্বান উপেক্ষা করে বিশ্বব্যাংক তার প্রতিষ্ঠানের মতাদর্শ ও মুনাফা নিশ্চিত করার প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগী বলে সমালোচকেরা বারবার অভিযোগ জানালেও বিশ্বব্যাংক তাতে সামান্যই কান দিয়েছে। ২০১১ সালে ফাঁস হওয়া বিশ্বব্যাংকের গোপন এক কৌশলপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘ছোট ছোট প্রকল্পের প্রস্তুতি এবং তদারকি ব্যয় বড় এবং কেন্দ্রীভূত প্রকল্পগুলোর তুলনায় বেশি। সে কারণে ব্যাংক ম্যানেজাররা ছোট প্রকল্পে অনুৎসাহী।’ এ কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণের স্বার্থে বিশ্বব্যাংক পাশে না দাঁড়ালে সরকারকে মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বিকল্প উৎসে মনোযোগ ফেরাতে হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের ব্যয় সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তি এবং জ্বালানির ধরন নির্ধারণে অন্যতম নিয়ামক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য যাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কেবল সেসব দেশের জন্য নয়, উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃত দেশগুলোর জন্যও বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের উৎপাদনমূল্য কত, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত ৩০ বছরে বিশ্বে কয়লা থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে। এবং এর প্রধান কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং তার পরিচালন ব্যয় তুলনামূলক কম। জলবায়ু পরিবর্তন ভাবনা এবং কঠিনতর পরিবেশ আইন প্রণীত হলেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থার বিলোপ ঘটবে এমন নয়। ইউরোপীয় কমিশন ও ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী, সমুদ্র ও স্থলভাগে বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি মেগাওয়াট/ঘণ্টা উৎপাদনমূল্য যথাক্রমে ৫০ ও ১৫৬ মার্কিন ডলার। সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সমপরিমাণ বিদ্যুতের জন্য ব্যয় ২২৬ ও ২০৩২ ডলার। স্থানভেদে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনব্যয় কোথাও কয়লা দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের সমান আবার কোথাও ২৪০-২৬৩ ডলার। সে তুলনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি মেগাওয়াট/ঘণ্টার জন্য ব্যয় ৫৬-৮২ মার্কিন ডলার।
২০১১ সালে ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর দুটি ছাড়া জাপানের অপর প্রায় ৫০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। বিকল্প ও পরিবেশসম্মত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সেখানে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে বিদ্যমান জাপানের মোট ৭ দশমিক ৪ গিগাওয়াট ক্ষমতার (এক গিগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রায় আড়াই লাখ বাড়ি আলোকিত করতে সক্ষম) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এ বছর প্রায় দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন উৎসাহিত করতে জাপানের ‘ফিড ইন ট্যারিফ’ (২০ বছরের জন্য সরকার বা বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি উচ্চমূল্যে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদকের কাছে কেনার গ্যারান্টি) ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছে সৌরবিদ্যুৎ। শুরুতে উৎপাদনকারী প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের জন্য ৪২ ইয়েন পর্যন্ত মূল্য পেয়েছে। এখন স্থান বিশেষে বিভিন্ন হলেও ইউনিটপ্রতি সৌরবিদ্যুতের জন্য উৎপাদনকারী ১০ শতাংশ কম মূল্য পাচ্ছেন। (জাপানে বিদ্যুতের মূল্য জার্মানি ও ফ্রান্সেরও চেয়েও বেশি)
কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার লক্ষ্যে কয়লা পুড়িয়ে পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যয় পর্যালোচনা চলমান। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির বিশেষজ্ঞদের অনুমান, বৈশ্ব্বিক উষ্ণায়ন রোধে কার্যকর ‘কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ’ প্রযুক্তিসহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিমাণ ২০৫০ সাল নাগাদ ৬৫ শতাংশে উন্নীত হবে। ফলে কয়লা তার জ্বালানি হিসেবে পরিবেশসম্মত অবস্থান ও গুরুত্ব বহাল রাখতে সমর্থ হবে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।