মূত্রশক্তি

সূর্য সম্ভবত সব সময়ই ছিল। কিন্তু সূর্যের অদৃশ্য আলোর মধ্যে যে শক্তি আছে তা মানুষ বহুকাল জানত না। প্রয়োজনের খাতিরে মাথা খাটাতে খাটাতে সূর্যের আলোকের শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করে। মানুষ বাবা আদম ও হাওয়া বিবির সময় থেকে মূত্র ত্যাগ করছে। কিন্তু এতকাল মানুষ জানত না যে মূত্রের মধ্যেও শক্তি রয়েছে এবং সে শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। সূর্যের আলো থেকে পাওয়া বৈদ্যুতিক শক্তিকে যেমন আমরা নাম দিয়েছি সোলার এনার্জি বা সৌরশক্তি, তেমনি মানবমূত্র থেকে যে বিদ্যুৎ আমরা পেতে যাচ্ছি, তার নামকরণ করতে পারি ইউরিন এনার্জি বা মূত্রশক্তি।
নরমূত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটিয়েছেন ব্রিটেনের বিজ্ঞানীরা। মূত্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ দিয়ে কলকারখানা না চললেও আপাতত মোবাইল ফোনসেট চার্জ করা যাবে। ব্রিস্টল রোবটিকস ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি মূত্র ব্যবহার করে মোবাইল সেট চার্জের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন। ব্রিস্টলের ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওয়েস্ট অব ইংলন্ডের পদার্থবিজ্ঞানী আয়োনিস আইরোপোলস জানান, এটি এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী আবিষ্কার। তিনি বলেন, বর্জ্য পদার্থ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘটনা পুরোনো। কিন্তু মূত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এটাই প্রথম। [রয়াল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি জার্নাল]
আইরোপোলস সাহেব বিলকুল ঠিক বলেছেন যে, বিদ্যুতের উৎস হিসেবে ব্যবহূত বিভিন্ন সম্পদ শেষ হয়ে গেলেও মূত্রের পর্যাপ্ত সরবরাহ সম্ভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য কারণে অন্য সম্পদের সরবরাহ সীমিত হয়ে এলেও মূত্রের ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা নেই। আমরাও হলফ করে তাঁর সঙ্গে যোগ করতে পারি, মূত্রশক্তি থেকে যখন বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হবে, তখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশ থাকবে শীর্ষে। আমরা নেপাল ও ভুটানে এমনকি ভারতেও কিছু রপ্তানি করতে পারব। কারণ, বাংলাদেশের মতো এত মূত্র পৃথিবীর খুব কম দেশেই উৎপাদিত হয়। বিদ্যুতের কাঁচামাল হিসেবে মূত্র এখানে শুধু পায়খানা-প্রস্রাবখানায় নয়—সর্বত্র। ফুটপাত প্লাবিত পুরুষের প্রস্রাবে। রাস্তার পাশের বড় বড় গাছের গোড়া সিক্ত নরমূত্রে। বাড়ি থেকে বেরোনোর পরেই অথবা বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগেই বঙ্গীয় পুরুষের প্রস্রাবের বেগ হয় প্রবল। তা নিঃসরণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থানের প্রয়োজন নেই। যখন যেখানে খুশি সেখানে দাঁড়িয়ে অথবা একটু কষ্ট করে উবু হয়ে বসে পড়বে।
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধান হবেই। তার জন্য আর কোনো মহাজোট মেগাজোটকেই জনগণকে কোনো রকম মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দরকার নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়। বস্তুত পৃথিবীর কোনো জনবহুল দেশেই বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে না। একদিকে সৌরশক্তি, আর একদিকে মূত্রশক্তি। দুটোই অফুরন্ত। তার পরেও বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিলে মূত্রশক্তি থেকে বিদ্যুৎ ওই সব দিনেই বরং বেশি উৎপাদিত হবে। ওই যে প্রাচীন জ্ঞানীরা বলেছেন: ‘আকাশে মেঘ, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ।’ অর্থাৎ মেঘ-বাদলাতেই মানুষের প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ে।
মূত্রশক্তির আবিষ্কার বাংলাদেশের জন্যই সবচেয়ে বড় সুখবর। বাংলার মাটিতে মানুষ বেশি। মূত্র বেশি। মোবাইল ফোন বেশি। আপাতত মোবাইল সেট চার্জ করতে মূত্রশক্তি থেকে যে বিদ্যুৎটা পাওয়া যাবে, সেটাই বা কম কী? গত নির্বাচনে বিজয়ী জোটের অঙ্গীকার ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ করার কথা। আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী জোটের নির্বাচনী ইশতেহার বাংলাদেশকে শুধু নতুন ধারার রাজনীতিতে প্রবেশের অঙ্গীকার নয়, মূত্রশক্তির নবযুগে প্রবেশের অঙ্গীকারও থাকবে বলে ধারণা করি।
তবে বাংলাদেশে মূত্রশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। বাধা আসতে পারে কোনো দিক থেকে। বিতর্ক হবে। গোলটেবিল আলোচনা হবে। টিভি টক শো হবে। মানববন্ধন হবে। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে মাথা ফাটবে জনা পঞ্চাশের। মতিঝিলে কংক্রিটের তৈরি জাতীয় ফুলটির পাদদেশে মহাসমাবেশও করতে পারে কোনো সংগঠন। সেখান থেকে দাবি ঘোষিত হতে পারে: পুরুষ জাতি ছাড়া অন্য কোনো মানুষের মূত্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার না-জায়েজ। কেন মূত্রশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অবৈধ নয়, তার কারণ দর্শিয়ে কেউ একখানা রিট ঠুকে দিতে পারেন।
অন্যদিকে প্রকল্প শুরুর আগেই আমাদের অতি সৎ ও সুদক্ষ জ্বালানি দপ্তর বিশ্বব্যাংকের অর্থসাহায্যে ১৬ কোটি প্লাস্টিকপাত্র তৈরির প্রকল্প যে দ্রুত গ্রহণ করবে না, তাই বা বলি কী করে? ঘরে ঘরে, অফিস-আদালতে, রাস্তাঘাটে প্রস্রাব সংগ্রহ প্রকল্প চালু হবে। লক্ষ্য—অমূল্য মূত্রধন যেন এক লিটারও নষ্ট না হয়। মূত্রের অপচয় রোধ করতে হবে জাতীয় স্বার্থে।
আসলে মূত্রের মতো অপবিত্র দ্রব্যকে নয়, জিন্দাবাদ দিলে দিতে হয় বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে। মানুষের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে, জীবনকে সুন্দর করতে যাঁরা নিরলসভাবে কাজ করেন। আরাম আয়েশ ছেড়ে যাঁরা ল্যাবরেটরিতে বসে দিনরাত সাধনা করেন। আবিষ্কার করেন নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। তেঁতুলতত্ত্ব বা লালাতত্ত্বের আবিষ্কারকদের নয়, আমরা তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতিকে স্বাগত জানাই এবং সেসব তত্ত্ব যাঁরা প্রয়োগ করে নতুন নতুন আবিষ্কার করে চলেছেন, তাঁদের জানাই সালাম।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।