প্রধানমন্ত্রীর নালিশ

গত শনিবার সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র, সরকার ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলো আলোচনার দাবি রাখে। সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য সাংসদকেও ছাড় দেওয়া হয়নি বলে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের দুই সাংবাদিককে নির্যাতনের দায়ে সরকারদলীয় সাংসদ গোলাম মাওলা রনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারের এই আইনি পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, সাংবাদিক নির্যাতন বা হয়রানির প্রতিটি ঘটনায় এ রকম ত্বরিত ও কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, ‘আপনাদের দ্বারা যখন ক্ষতবিক্ষত হই, তখন আমরা কার কাছে যাব? কোথায় বিচার পাব? জানি না। এই নালিশটুকু রেখে গেলাম।’ প্রধানমন্ত্রীর কথায় আবেগ ও বেদনা প্রকাশিত হলেও বাস্তবতার সঙ্গে এর কতটা মিল আছে, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়। গণমাধ্যমের কাজ কাউকে রুষ্ট বা তুষ্ট করা নয়। তার দায়িত্ব হচ্ছে সঠিক তথ্যটি জনগণকে জানানো। সে ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে সরকার অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু দেখতে হবে, সেই আইনি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অযথা যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বর্তমান সরকারের আমলে আইন সংশোধন করে মানহানি মামলায় অভিযুক্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের যে সুযোগ রাখা হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার, বিরোধী দল, গণমাধ্যম এবং সমাজ শক্তির অন্যান্য অংশ যার যার সীমারেখার মধ্যে অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে কাউকেই ক্ষতবিক্ষত হতে হয় না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারকে অন্যায়ভাবে ক্ষতবিক্ষত করার জন্য সাংবাদিক সমাজের কাছে নালিশ জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা তাঁর এ বক্তব্য সমর্থন করে না। বরং দেখা যাচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা অনেক সময়ই সরকারি দলের নেতা-কর্মীসহ ক্ষমতাবানদের হাতে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন এবং খুব কম ক্ষেত্রেই আইনি প্রতিকার পাচ্ছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, সাংবাদিকদের যেমন বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল হতে হবে, তেমনি সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, সঠিক সংবাদ পরিবেশনের কারণে জাতীয় সংসদে প্রথম আলোসহ জাতীয় গণমাধ্যমগুলোকে তুলোধোনা করা হয়েছে। এমনকি সম্পাদককে সংসদে তলব করার কথাও বলেছেন কোনো কোনো সাংসদ। কিন্তু সংবাদের কোথায় ভুল, কোথায় সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে, সে কথা নির্দিষ্ট করে তাঁরা বলেননি। গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যায় এমন সমালোচনা থেকে সাংবাদিকদের বিরত থাকতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর জবাবে সবিনয়ে তাঁকে জানাতে চাই, গণমাধ্যমের সমালোচনায় কখনো গণতন্ত্র ধ্বংস হয় না। বরং রক্তচক্ষু দিয়ে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করলেই গণতন্ত্র ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।