বিএনপির পায়ে আওয়ামী লীগের জুতা?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

গত রোববার এক সমাবেশে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দুটি কঠোর মন্তব্য সবাইকে বিস্মিত করেছে। প্রতিবাদ সভায় একটু রুক্ষ ভাষায় কথাবার্তা হয়েই থাকে। কিন্তু মূল নেতারা সাধারণত অতটা উত্তেজিত হন না। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় নাকি ‘কটূক্তি’ করেছেন। তারই প্রতিবাদে ওই সমাবেশ ছিল। সেখানে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে এলে ‘আওয়ামী লীগ খড়কুটোর মতো’ ভেসে যাবে। আওয়ামী লীগের হূৎকম্প উপস্থিত করানোর জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী বাক্য তিনি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এর ফলাফল কোন দিকে যাবে, তা কি তিনি ভেবে দেখেছেন?
সাদেক হোসেন খোকার হুঁশিয়ারি ছিল আরেক কাঠি সরস। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এই একটি উক্তিই যথেষ্ট।
সবার মনে আছে, ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। বিএনপি সরকার বিচারকদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছর করায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ এর ঘোরতর প্রতিবাদ করতে থাকে। কারণ, অতীতে বিএনপির সঙ্গে কে এম হাসানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার মতো হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে। ঢাকায় অন্তত পাঁচজন ও সারা দেশে তিন দিনে প্রায় ২৩ জন নিহত হন। এঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী-সদস্যও ছিলেন। কেউ এ ধরনের আন্দোলন সমর্থন করেনি। এখনো করে না। এমনকি আওয়ামী লীগও ওই আন্দোলনের দায় নিতে চায় না। লগি-বৈঠার রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলতে পারলেই যেন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল বাঁচে।
এখন বিএনপির নেতা আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত জুতায় পা ঢোকাতে চান! সেদিনের যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সংশ্রব আওয়ামী লীগ ত্যাগ করতে চায়, বিএনপি আজ সহিংসতার সেই অভিশপ্ত পথে হাঁটতে চায়। এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?
এ বিষয়ে জানার জন্য সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। তিনি বলেন, সম্প্রতি পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে বিএনপির সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার খুলে গেছে। বিশেষত, আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতেও বিপুল ভোটে বিএনপি-সমর্থিত সিটি মেয়রের জয়লাভকে তাঁরা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করেন। এর ফলে বিএনপির মধ্যে একধরনের ইউফোরিয়া বা রমরমা ভাব সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করেন, এ অবস্থায় বিএনপিকে আরও সংযত হতে হবে, কারণ অতি আত্মবিশ্বাস ক্ষতিকর হতে পারে। বিএনপি নেতাদের কোনো উক্তি সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য না করে তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেন, বিএনপিকে হতে হবে বিনয়ী। যুক্তিসিদ্ধ কথা বলতে হবে। তিনি মনে করেন, জাতি এখন চায় বিনয়ী আচরণ।
স্পষ্টতই বিএনপির একটি ধারা যেমন কঠোর পথে যেতে চায়, তেমনি অপেক্ষাকৃত নমনীয় ও যুক্তিপূর্ণ পথ অনুসরণের পক্ষেও একটি ধারা রয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১৮ জুলাই এক ইফতার অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছেন, আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে তাঁরা নতুনধারার সরকার গঠন করবেন। সেখানে দেশের জ্ঞানী-গুণীজনকে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা তাঁদের রয়েছে। তাঁর এই মত সম্পর্কে দেশবাসীকে এখনো পুরোপরি জানানো হয়নি। এমনকি দলের নেতারাও জানেন না। খালেদা জিয়ার এই চিন্তা ইতিবাচক।
দলনেত্রীর এই চিন্তার সঙ্গে বিএনপির নেতাদের সাম্প্রতিক কথার মিল নেই। তিনি নরম। আর অন্য নেতাদের কেউ কেউ কঠোর।
তাহলে দেশ কোন পথে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন করেছিলাম মাহবুবুর রহমানকে। তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, পরিস্থিতি ভালো নয়। অন্ধকার গলির দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এটা প্রত্যাশিত না, এ অবস্থা থেকে সরে আসতে হবে। তিনি মনে করেন, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব আছে, তবে সরকারের দায়িত্ব বেশি। সংলাপের মাধ্যমে সমাধানে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব বেশি।
মাহবুবুর রহমান খুব খোলা মনের মানুষ। ১৯৯৬ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সশস্ত্র বাহিনীতে উত্তেজনা দেখা দিলে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে সরিয়ে তাঁর স্থলে জেনারেল মাহবুবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। ওই সময় বাংলাদেশ এক ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়ে। নির্বাচন বরবাদ হতে পারত। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ়তা এবং নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল মাহবুবুর রহমানের সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের ফলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
আজ দেশের সামনে আরেকটি সংকট। এবং মাহবুবুর রহমান বিএনপির মূল নেতাদের অন্যতম। তিনি আজও যুক্তিনির্ভর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলছেন। এ রকম চিন্তার নেতা বিএনপিতে আরও আছেন। ৯ জুলাই প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য একটি কার্যকর আলোচনা এখনই শুরু করার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো কারণে গণতন্ত্র যদি হোঁচট খায়, তাহলে তারা বা আমরা জনগণের কাছে দায়ী থেকে যাব।’ নিজেদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে এ ধরনের সচেতনতা এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন।
এখন যদি বিএনপির বিবেচনাবোধ লোপ পায় এবং সত্যিই যদি লগি-বৈঠার চেয়েও ভয়ংকর কর্মসূচি দেয়, তাহলে খুব খুশি হবে জামায়াতে ইসলামী। ২০০৬ সালেও ওরা ছিল খুব উৎসাহী পক্ষ। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর পাশের গেটে সমাবেশ দিয়ে তারা ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজি’—এই স্লোগান দিয়ে অস্ত্র-লাঠিসোঁটা-ইট-পাটকেল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পল্টনের মোড়ে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা সমাবেশের ওপর।
যদি এবার লগি-বৈঠা মার্কা সমাবেশের চেয়েও কঠোর কিছু করার ডাক দেয় বিএনপি, তাহলে জামায়াতের পোয়াবারো। ওরা তো ওত পেতে আছে, কখন ডাক আসে। কারণ, তাদের দল টিকিয়ে রাখতে হলে একটা আশ্রয় চাই। এবং বিএনপি তাদের জন্য খুব ভালো ও নিরাপদ আশ্রয়।
বস্তুত জামায়াতে ইসলামী দলটি আমাদের রাজনীতিতে একটি পরগাছা দল। ওরা একা নির্বাচন করলে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। আর অন্য দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে কপাল খুলে যায়। বিএনপির সঙ্গে থেকে নির্বাচন করে জামায়াতে ইসলামী ১৯৯১ সালে পায় ১৮ ও ২০০১ সালে ১৭টি আসন। পক্ষান্তরে ১৯৯৬ সালে একা নির্বাচন করে ওরা পায় মাত্র তিনটি আসন। আসলে এটাই তাদের প্রকৃত অবস্থান। বিএনপি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে তাদের আসনসংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। জামায়াতের বিএনপিকে চাই-ই চাই, কিন্তু বিএনপির জন্য জামায়াত অপরিহার্য নয়। নির্বাচনী লড়াইয়ে বিএনপির জন্য জামায়াতের আশীর্বাদের দরকার পড়ে না।
এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। জামায়াত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মনেপ্রাণে চাইছে বিএনপির সঙ্গে ঝুলে থাকতে। একটা সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া এই সময়ে জামায়াতের এজেন্ডা হতে পারে, বিএনপির নয়।
বিএনপিকে এখন ঠিক করতে হবে, ওরা কি জামায়াতের চাল চালতে গিয়ে আওয়ামী লীগের পুরোনো জুতা পায়ে লাগাবে, নাকি নিজেদের স্বাধীন চিন্তাকে প্রাধান্য দেবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]