ইবোলার পরবর্তী শিকার কে?

.
.

পশ্চিম আফ্রিকার বাইরে আরও কিছু দেশ ইবোলা মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে? বিশেষজ্ঞরা অবশ্য উন্নত দেশগুলো নিয়ে তেমন একটা চিন্তিত নন। কারণ, সেসব দেশের রোগ নিরাময়ের উন্নত ব্যবস্থা আছে, এমনকি তারা কম জনসংখ্যার উন্নয়নশীল দেশগুলো নিয়েও তেমন একটা চিন্তিত নন। কিন্তু সাধারণভাবে রোগ নিরাময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেই, এমন ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলো এ রোগের ঝুঁকিতে আছে।
যেমন, ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে এ রোগ ছড়িয়ে পড়লে একদম বিপর্যয় নেমে আসবে। সেখানে শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি, গণস্বাস্থ্য কাঠামোও খুব দুর্বল, ফলে ভারতে ইবোলা ছড়িয়ে পড়লে তার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হবে না। ভারতের সঙ্গে পশ্চিম আফ্রিকার সম্পর্ক খুব নিবিড়, সে অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার ভারতীয় বসবাস করছে। যে সম্পর্কের সূত্রপাত গত শতকে।
আফ্রিকার আক্রা, লাগোস, ফ্রি টাউন, মনরোভিয়া, আবিদজান প্রভৃতি শহরের সঙ্গে ভারতের নয়াদিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই ও চেন্নাইয়ের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ এসব শহরের একটি থেকে আরেকটিতে যাতায়াত করে। তারা মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপ হয়ে এসব শহরে যাতায়াত করে থাকে। যদিও আক্রান্ত অঞ্চলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে আট থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। ফলে এ রোগের ভাইরাস শরীরে নিয়ে বহু মানুষ অনায়াসে ভারতে ঢুকে যেতে পারে।
সম্প্রতি নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে দেখলাম, ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রবেশ ঠেকাতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা খুবই ঢিলেঢালা। ফলে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কেউ শরীরে এ রোগের ভাইরাস নিয়ে ভারতে ঢুকলে দেশটি তা ঠেকাতে পারবে না।
ভারতের বড় শহরগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০ হাজার। এতে এসব শহর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির শহরের পর্যায়ে চলে গেছে। গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহরে আবাস গড়ায় শহরের যত্রতত্র বস্তি গড়ে উঠেছে। স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল, শহরে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তার তুলনায় সেটা খুবই কম।
আর বড় শহরের বাইরে স্বাস্থ্যসেবার অর্থ প্রাথমিক চিকিৎসার বেশি কিছু নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ভারতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৬ দশমিক ৫ জন চিকিৎসক, ১৩ জন নার্স ও হাসপাতালে নয়টি আসন রয়েছে। বৈশ্বিক মান অনুসারে এটা অর্ধেকেরও কম, আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের চেয়ে তা অনেক কম।
শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব, ঘুপচি বস্তি, দুর্বল স্যানিটেশন, ড্রেনেজ, সুয়ারেজ ও কমজোর স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থার কারণে ভারতে ইবোলা দেখা গেলে তা কীভাবে ছড়িয়ে পড়বে, সেটা আমাদের কল্পনারও বাইরে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে একজন মানুষও শরীরে এ ভাইরাস নিয়ে এলে ভারতে তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে।
ভারতীয় সরকার বলছে, তারা এটা মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুত। একবার ছড়িয়ে পড়লে বড় শহরের বাইরে সীমিত সম্পদ ও অর্ধপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবীরা যে সহজেই এতে আক্রান্ত হয়ে পড়বে, এটা সহজেই অনুমেয়। মাদ্রিদ ও ডালাসে যেটা ঘটেছে, পশ্চিম আফ্রিকার কথা না হয় না-ই বললাম। ইবোলার রোগলক্ষণ ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুজ্বরের মতো, ফলে স্বাস্থ্যসেবীরা না বুঝেই কোনো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নাও নিতে পারেন। আবার, তাঁরা রোগীদের খুবই খারাপ অবস্থায় বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারেন। ফলে বিপদের আর অন্ত থাকবে না।
সরকারের হাতে সুযোগ খুবই সীমিত। স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা গভীর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, যেটা রাতারাতি কাটিয়ে ওঠা যাবে না বা শুধু ইবোলার ধাক্কায় তা ঠিক হবে না। সরকার যেটা করতে পারে তা হচ্ছে, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসা লোকজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের চোখে চোখে রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ঠিক যা করতে শুরু করেছে।
সবচেয়ে ভালো হয়, যদি পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কোনো যাত্রী আসামাত্রই তাদের আলাদা করে ফেলা ও পরবর্তী আট দিন তাদের নজরদারিতে রাখা হয়। কিন্তু সেটা ঠিক ন্যায্য হবে না, আর দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমান ও সমুদ্রবন্দরে এ কর্মসূচি চালানোর সক্ষমতা ভারত সরকারের আছে কি না, সেটাও সন্দেহের ব্যাপার।
এর বদলে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আগত ব্যক্তিদের এ রোগের লক্ষণ সম্পর্কে আগেভাগে সচেতন করা যায়। কীভাবে নিজেদের নজরদারিতে রাখা যায়, সে বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, আর এ রোগের প্রথম লক্ষণ দেখা দিলে যে চিকিৎসা নিতে হবে, সে বিষয়ে তাদের সচেতন করা যায়। তদুপরি, শহরাঞ্চলের সব জায়গায় স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের প্রশিক্ষিত করা উচিত। তাঁরা যেন রোগীদের রোগ ও ভ্রমণের রেকর্ড রাখেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
পশ্চিম আফ্রিকায় সম্প্রতি যে ইবোলা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বোঝা যায়, বাস্তুতন্ত্রে একধরনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এ ভাইরাস বহনকারী বাদুড় কলায় কামড় দিলে আর সে কলা মানুষ খেলে ভাইরাসটি মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম আফ্রিকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ঘনত্বের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ যে সুরক্ষা দিতে পারত, সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। গিনি, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে এটা তেমন প্রযোজ্য নয়।
ভারতে ইবোলা ছড়িয়ে পড়বে, এটা এখনো একটা সম্ভাবনার পর্যায়ে আছে। ফলে তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে—নাইজেরিয়া ঠিক যা করেছে। লাগোস ভারতের বড় শহরগুলোর মতোই, সেখানে ইবোলা প্রতিরোধে নাইজেরীয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। ভারতের উচিত, সেটা অনুসরণ করা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
হৃষভ সন্দিলা: চেক প্রজাতন্ত্রের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির প্রভাষক।
ড্যানি শোহাম: ইসরায়েলের বেগিন সাদাত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের জ্যেষ্ঠ গবেষক।