অভিজিৎ ও জোনাকি

অভিজিৎ রায়
অভিজিৎ রায়

২০০৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে, বাংলা একাডেমির দেয়াল ঘেঁষে ওত পেতে থাকা গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের। না, কোনো কুশল বিনিময় হয়নি পরস্পরের। অন্ধকারের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয় না কখনো। অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিন প্রথাবিরোধী শিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি মানুষটির ওপর। সেদিনের চাপাতি হুমায়ুন আজাদের মাথার নাগাল পায়নি। কারণ, ঘাতকেরা বা আক্রমণকারীরা তাঁর তুলনায় নিশ্চয়ই বামনাকৃতির ছিল। হুমায়ুন বরাবর দীর্ঘকায় ছিলেন। মন ও শরীরের উচ্চতায়। উদ্যমে। সাহসে। 
মনে পড়ছে, ১৯৯৯ সালে পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী ড. আহমদ শরীফের মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নাগরিক শোকসভা আয়োজিত হয়েছিল। আহমদ শরীফের একসময়ের ছাত্র ও পরে সহকর্মী হুমায়ুন আজাদ বক্তৃতা দিতে এসে বলেছিলেন, কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়াশীলতা ও দৈন্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন মাথা উঁচু করা সাহসী মানুষ। তাঁর মাথা উঁচু হতে হতে আকাশ স্পর্শ করেছিল। এই মাথা উঁচু করা মানুষটি চলে যাওয়ার পর আমাদের চারপাশে বামন ছাড়া আর কিছু থাকল না। আমরা সবাই সেদিন হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যে কটাক্ষ বোধ করেছিলাম, আহত হয়েছিলাম। কিন্তু যত দিন গেছে, তারপর চারপাশ দেখে দেখে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, হুমায়ুন আজাদ ‘বামন’ বলতে আমাদের মানসিক দৈন্যকেই চিহ্নিত করেছিলেন। যদিও আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখন প্রধানত হীনতা ও দীনতার ধারক ও বাহক। তাই হুমায়ুন আজাদও রক্তাক্ত হয়েছিলেন এবং যদিও সেদিন তাঁর মাথায় আঘাত করতে পারেনি ঘাতকের চাপাতি, কিন্তু তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্ধকার তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে।
বিশ্বাস করি, অভিজিৎ রায় এসব ঘটনার পূর্বাপর জানতেন। তাঁর বিশ্বাসের জগৎ ছিল মানুষমুখী। যাতে মানুষের কল্যাণ হয়, সমাজ থেকে কূপমণ্ডূকতা দূর হয়, বিজ্ঞানমনস্ক বোধ নিয়ে আমরা যেন আমাদের চারপাশকে ব্যাখ্যা করতে পারি, কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারি, নিজের লেখাসমূহে, নিজের ব্লগ ‘মুক্তমনা’য় অভিজিৎ তা–ই করে যাচ্ছিলেন। ইতিহাসসচেতন হিসেবে তিনি আমাদের অতীত সংগ্রামের গৌরব ও বেদনার পদাবলি পাঠ করে করে নিজ ভাষ্যে শুনিয়েছেন বারবার। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তাই অভিজিতের কাছে নিতান্তই একটি তাৎক্ষণিক হত্যাকাণ্ড নয়। অভিজিৎ এই উপলব্ধি প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীসমূহ এবং জামায়াত-শিবির চক্র নির্বিষ ঢেঁাড়া সাপ নয়, ওরা প্রত্যেকেই এক একটি কাল কেউটে, ছোবলভরা যাদের নীল বিষ। ওরা একটি ভয়ের নাম। সেই ভয়কে রাষ্ট্র লালন করে। ক্ষমতার পালাবদলে কাজে লাগায়। সমাজে পুনর্বাসিত করে। অভিজিৎ ভয়ের রাষ্ট্রকে অচলায়তন হিসেবে চিনেছিলেন এবং তাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যা দরকার, তা–ই তিনি করেছিলেন, নিজেকে ভয়ের বৃত্তের বাইরে এনেছিলেন সবটুকু। ভয়ের বৃত্ত ভাঙতে হলে সাহস প্রয়োজন হয় অনেক বেশি, নতুন জীবন নির্মাণে ভালোবাসতে হয় অনেক জীবনকে। অভিজিৎ দুটোই করেছিলেন। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় অভিজিৎ কখনো পরাজিত হবেন না।
যতবার সমাজে মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত এসেছে, প্রতিবাদও হয়েছে এবং প্রতিবাদও করেছে মুক্তচিন্তার মানুষেরাই। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ থেকেছে নিশ্চুপ। হয়েছে পর্যবেক্ষক। তাহলে কি যাঁরা কুবুদ্ধি ও কুসংস্কার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করার লড়াই করছেন, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকটজন হতে পারছেন না? তার মানে কি এই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রতিক্রিয়াশীল? প্রগতিপন্থী নন? দিনে দিনে মানবেতর জীবনযাপনে অনিচ্ছুক ডুবে যাওয়া এই বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদহীনতা, নির্লিপ্তি, আস্থাহীনতা আমাদের মৌলিক পরিচয়ের সামনে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো করে দাঁড়িয়েছে। সাহসী জাতি হিসেবে যাদের বিশ্ব চেনে ও জানে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা যাদের সংস্কৃতির মূল সুর, প্রগতির পথে জাতি হিসেবে যাদের পা অগ্রগামী, সেই মানচিত্রের এই মৌনতা অস্বাভাবিকই শুধু নয়, সীমাহীন দৈন্যেরও। আমরা কি তবে দীনতার অতলে ডুবেছি? কে ডোবাল আমাদের? লোভ? ভয়?
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুসংবাদ যখন জেনেছি, তার কিছুক্ষণ আগে একটি বইয়ের অসমাপ্ত পাঠ শেষে বইটির মলাট বন্ধ করেছিলাম। বইয়ের নাম ভয়ের সংস্কৃতি। লেখক আলী রীয়াজ। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ফেসবুক মেসেঞ্জারে খুঁজতেই তাঁকে পেয়ে যাই। অসহায়ত্ব নিয়ে জানতে চাই তাঁর কাছে, ‘শুনেছেন তো?’ আলী রীয়াজ উত্তর করেন, ‘এই সংস্কৃতি আমরা সবাই মিলে তৈরি করেছি এবং তার জন্য অনেক চড়া মূল্য দিচ্ছি।’ ‘কীভাবে এর শেষ হবে? শেষের লড়াইটা কোথা থেকে শুরু হবে? কারা শুরু করবে?’—আমার পরের প্রশ্ন। উত্তর করেন আলী রীয়াজ, ‘কোটি টাকার প্রশ্ন। আসলে কি এটা লড়াই, যেটা অধিকতর খারাপ হচ্ছে? এখন কি নিজেদের খতিয়ে দেখার সময় না? আমরা তো এক দিনে এখানে আসিনি।’
ঠিক। খুব সত্যি কথা। আমরা, মানে বাংলাদেশ এক দিনে এখানে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর যখন যাঁরা যেমন পেরেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যেতে চাওয়ার জন্য মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির সহযোগিতা নিয়েছেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। বিনিময়ে সব অপশক্তিকে রাষ্ট্র ও সমাজে ধারাবাহিকভাবে পুনর্বাসিত করেছেন। সংবিধানে প্রগতিবিরোধী সংশোধনী এনেছেন। দমন ও পীড়নের হাত শক্তিশালী করেছেন লুটেরা সম্প্রদায়ের শ্রেণিস্বার্থে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ছিন্নভিন্ন হয়েছে সমাজে। কর্তৃত্বপরায়ণ মনস্তত্ত্ব ঘুণপোকার মতো সামাজিক বোধের মগজকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলেছে।
যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রগতিশীলতা এভাবেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে মৌলবাদের, কুসংস্কারের ও অন্ধকারের। কিন্তু অন্ধকারের ভাবাদর্শ রাষ্ট্রে ছড়িয়ে গেছে তত দিনে অনেকখানি। প্রতিরোধহীন প্রতিকারহীন অন্ধকারে হুমায়ুন আজাদ, রাজীব ও অভিজিৎ জোনাকির মতো মিটিমিটি জ্বলে ওঠেন যখন, তখন আমরা বুঝতে পারি অন্ধকার কতটা গাঢ়! আমাদের ভয়ের অন্ধকার, নির্লিপ্তির অন্ধকার, কুৎসিত লোভের অন্ধকার। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ শিরোনামে কবে নবারুণ ভট্টাচার্য একটি অসাধারণ কবিতা লিখেছেন। সেই কবিতা থেকে একটি লাইন উদ্ধৃত করছি, ‘যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে, আমি তাকে ঘৃণা করি।’
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]