আমরা এখন মধ্য-আয়ের

গতকাল সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে, পত্রিকা হাতে পাওয়ার আগেই ল্যাপটপ খুলে, প্রথম আলোর প্রধান খবরটি পড়ে চনমনে হয়ে উঠলাম। বাংলাদেশ এখন মধ্য-আয়ের দেশ।
অভিনন্দন বাংলাদেশের সব মানুষকে, অভিনন্দন আমাদের খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক-ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা-চাকরিজীবী ও প্রবাসী মানুষদের। অভিনন্দন আমাদের নেতাদের। অভিনন্দন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সবাইকে।
মধ্য-আয়ের দেশ হওয়ার কতগুলো সুবিধা আছে, কতগুলো অসুবিধাও আছে—গতকালের খবরেই প্রথম আলোর প্রতিবেদক শওকত হোসেন লিখেছেন। অসুবিধা হলো, আমরা গরিব মানুষ, এইটা আমাগো এমনি এমনি দ্যান, এই বুলি আর চলবে না। আর সুবিধা হলো, ও একেবারেই গরিব না, ওকে ঋণ দাও, ও শোধ দিতে পারবে, এই তুমি মাটিতে বসেছ কেন, টেবিল-চেয়ারে বসে খাও—এই রকমটা হবে।
কী রকম গরিব একটা দেশ ছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এবারের বাজেট ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। কোটিটা বাদ দিলে তুলনাটা সহজ হবে। আপনার সংসারে আগে ৭৮৬ টাকা ছিল। আর এখন আছে ৩ লাখ টাকা। আপনার পরিবারে আগে মানুষ ছিল ৭ জন, এখন হয়েছে ১৫ জন। আপনি কি আগের তুলনায় বড়লোক হয়েছেন?
গরিব থেকে আপনি যখন মধ্যবিত্ত হন, তখন কী হয়? আপনার ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আপনার সক্ষমতা বাড়বে। আপনার ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে। আর শিক্ষা একটা আশ্চর্য পরশমণি, এর ছোঁয়ায় যেকোনো মানুষ সোনা হয়ে উঠতে পারেন। আমরা দেখতে পাই, কোনো অজানা গ্রাম থেকে উঠে আসছেন ছেলেপুলেরা, তাঁরা চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হচ্ছেন, বিশাল ব্যবসায়ী হচ্ছেন—আজ যাঁরা দেশের সফলতম মানুষ, এঁদের আশি ভাগের জীবনকাহিনি শুনলে জানা যাবে, প্রায় নিঃস্ব অবস্থা থেকে তাঁরা শুরু করেছিলেন, আজ তাঁরা সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছেন। গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।
আর মাথাপিছু আয় যখন বাড়ে, তখন সুশাসনও আসবে। গরিব দেশে সুশাসন আসে না। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের মুশতাক এইচ খান যেমনটা বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়লে সুশাসন আসাটা সহজ হয়।
কাজেই আমরা কেবল একটা সচ্ছল দেশ পাব তা নয়, আমরা একটা সুশাসন-সুন্দর দেশও এরপর থেকে আসা করতে পারি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারও কথায় কথায় অনেকবার বলেছেন, পুঁজি যখন গড়ে ওঠে, পৃথিবীর সর্বত্রই তা ছিল লুটেরা পুঁজি, কিন্তু পুঁজি গড়ে ওঠার পরে তা নিজের স্বার্থেই নিজেকে পাহারা দেয়। তার তখন আইনের শাসন লাগে, আইনকানুন লাগে, গণতন্ত্র লাগে, সভ্যতা লাগে।
আজ আমি গদ্যকার্টুন লিখতে বসেছি। সিরিয়াস তথ্য আলোচনা করতে নয়। কাজেই অতি পুরোনো কৌতুকগুলো আবারও বলি।
নিউইয়র্কে বিড়ালদের লড়াই হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বিড়াল অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের বিড়ালের সঙ্গে কেউ পারে না। বাংলাদেশের বিড়ালই শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হলো। শেষে আমেরিকার বিড়াল বলল, আমরা এই প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির পেছনে মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছি, কত প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তারপরও তোমার কাছে হেরে গেলাম। তুমি আসলে কার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছ?
বাংলাদেশের বিড়াল বলল, আমি তো আসলে বিড়াল না, আমি আসলে বাঘ, না খেতে পেয়ে পেয়ে বিড়ালের মতো ছোট হয়ে গেছি।

>ভাগ্যিস, এনডিটিভিতে একটা টক শে​া ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে প্রহ্লাদ কক্কর নামের একজন ভারত বিজ্ঞাপনগুরু বললেন, এই জিনিসটা খুবই ক্রিয়েটিভ হয়েছে, কাটারের সঙ্গে কাটারের মিল দেওয়া, এটাকে এত সিরিয়াসলি নেওয়ার কী আছে?

আজ কিন্তু এই কৌতুক আর চলবে না। বাংলাদেশের বাঘেরা এখন বাঘ হয়ে গেছে।
বাচ্চা আর বাচ্চা নেহি।
ও আচ্ছা, টেলিভিশনে সারাক্ষণ হিন্দিতে এই বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলো, ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট সিরিজের আগে। আমি এই বিজ্ঞাপনটা সহ্য করতে পারতাম না, এটা শুরু হলেই চ্যানেল বদলে দিতাম। দুটো দেশ খেলছে, দুটোই আইসিসির পূর্ণ সদস্য, একটা দেশকে কেন বাচ্চা বলা হবে।
তারপর রস+আলোতে একটা কৌতুক প্রকাশিত হলো।
তারপর গোটা ভারতের সংবাদমাধ্যমে মহা হইচই।
ভাগ্যিস, এনডিটিভিতে একটা টক শো ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে প্রহ্লাদ কক্কর নামের একজন ভারত বিজ্ঞাপনগুরু বললেন, এই জিনিসটা খুবই ক্রিয়েটিভ হয়েছে, কাটারের সঙ্গে কাটারের মিল দেওয়া, এটাকে এত সিরিয়াসলি নেওয়ার কী আছে? আমরাও তো বাচ্চা আর বাচ্চা নেহি বিজ্ঞাপন বানিয়েছি।
রসিকতা করা খুবই বিপজ্জনক।
দুটো গল্প বলব। একটা পড়েছি একটা রুশ হাসির গল্পের সংকলনে।
একজন একটা হাসির পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
তাঁর কাছে এসে তাঁর এক সহকর্মী বললেন, স্যার, আপনাকে একটা কৌতুক বলি।
বলেন।
চিকিৎসকের কাছে এক রোগী এল। রোগীর পায়ে ব্যান্ডেজ। চিকিৎসক বললেন, কী হয়েছে?
রোগী বলল, আমার মাথায় ব্যথা পেয়েছিলাম।
মাথায় ব্যথা পেয়েছেন, তো পায়ে ব্যান্ডেজ কেন?
জি মানে, ব্যান্ডেজটা মাথায় করেছিলাম, কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে পিছলে পা পর্যন্ত চলে এসেছে।
অফিসের সবাই হাসতে লাগল। কিন্তু সম্পাদক গম্ভীর। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হলো, এই ব্যান্ডেজ পায়ে যাবে কীভাবে? গলায় আটকে যাবে না? মাথা তো একটা, পা তো দুটো...এটা কোনো গল্প হলো...
এইটাই একটা কৌতুক। কৌতুক শেষ।
সবাই কৌতুক বুঝতে পারে না। আবার কেউ কেউ আছেন, যাঁরা মনে করেন, সবকিছু সিরিয়াসলি নিতে হবে।
যেমন মিলান কুন্ডেরার একটা উপন্যাসে একজন চিকিৎসক বন্ধ্যাত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি রোগিণীদের ইনজেকশন দেন। আর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেপুলেদের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখেন, তারা দেখতে তাঁর মতো হয়েছে কি না।
তো একবার মিলান কুন্ডেরার কাছে বন্ধ্যাত্ববিষয়ক চিকিৎসকদের একটা সেমিনারে পেপার পড়ার আমন্ত্রণ এল। মিলান কুন্ডেরা বললেন, আমি তো এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই।
চিকিৎসকেরা বললেন, না না, আপনি আপনার উপন্যাসে এই বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
আমি তো ইয়ার্কি করেছি। আমার লেখাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।
চিকিৎসকেরা খুবই মর্মাহত হলেন, বললেন, আপনি এটা কী বলছেন, আপনার লেখাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই? আপনার লেখাকে সিরিয়াসলি নিয়ে আমরা এত দিন ভুল করেছি?
আমি যদি বলি, রস+আলোর লেখাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই, তাতেও অনেকেই রাগ করবেন।
কাজেই রস+আলোওয়ালাদের বলব, আরও সাবধান হোন। ক্রিকেট জিনিসটা এবং যেকোনো খেলা জাতিতে জাতিতে, মানুষে মানুষে মৈত্রী স্থাপনের জন্য; বৈরিতা তৈরির জন্য নয়। খেলা খেলাই, তাতে হার থাকবে, জিত থাকবে, হারলেই...দ্যাটস নট দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড।
লেখাটা শুরু করেছিলাম সুসংবাদ দিয়ে। আমরা আর গরিব নই। আমরা এখন নিম্নমধ্যবিত্ত। এখন আমাদের গম্ভীর হতে শিখতে হবে। কথায় কথায় হাসি-তামাশা করা যাবে না। বড়লোকেরা কম হাসেন। তাঁদের হাসি স্মিত। তাঁরা স্মাইল করেন। মোনালিসার মতো রহস্যময় হাসি হাসেন। আর হ্যাঁ, গরিবদের দেখলে লাফ অ্যাট করেন।
আর আমাদের বাঘদের এখন খেলতে হবে বাঘদের সঙ্গেই। বিড়ালের সঙ্গে খেলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিন শেষ।
একটা নির্দোষ পুরোনো কৌতুক বলে শেষ করি।
ইঁদুর লাফাচ্ছে, বাঘের বিয়ে, আমাকেও দাওয়াত দিয়েছে, যেতে হবে।
খরগোশ বলল, বাঘের বিয়ে, তো তুই ইঁদুর লাফাচ্ছিস কেন?
ইঁদুর বলল, আসলে আমিও তো বিয়ের আগে বাঘই ছিলাম, বিয়ের পরেই না ইঁদুর হয়ে গেলাম।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।